ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে ১৭৮ একর ভূমি ॥ সমাধান মিলছে না দুই মন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও

রেল ও বন্দরের বিরোধ তুঙ্গে

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮

রেল ও বন্দরের বিরোধ তুঙ্গে

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মধ্যে ভূমি নিয়ে বিরোধ প্রায় ৬০ বছর ধরে। রেলের জায়গা চট্টগ্রাম বন্দরের নামে বিএস জরিপ হওয়ায় এ বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি রেলের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান ভূ-সম্পত্তি বিভাগের। প্রায় ১৭৮ একর ভূমি নিয়ে উভয় দফতরের বিরোধ নিয়ে গত রবিবার নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও রেল মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও সমাধান হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, কমিটির আহ্বায়ক রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কমল কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে নয় সদস্যের কমিটি তদন্তের পর তদন্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে দুটি দফতরের বিরাজমান দ্বন্দ্ব আদৌ শেষ হওয়ার কোনও কিনারা পাওয়া যায়নি। তবে বৈঠকে প্রায় দেড় একর জায়গায় রাস্তা নির্মাণ এবং বন্দর ও রেলের ব্যবহৃত বাসাগুলো পারস্পরিক বিনিময়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন রেল সচিব মোফাজ্জল হোসেন। আরও অভিযোগ রয়েছে, আকস্মিকভাবে বর্তমানে বন্দরের দাবিকৃত ৬৫ একর ভূমি বন্দর কর্তৃপক্ষ বিগত সময়ের সভাগুলোতে দাবি না করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বেআইনীভাবে উচ্ছেদ করেছে আগ্রাবাদ ঢেবার পশ্চিম পাড়স্থ রেলের জায়গায় থাকা সালাউদ্দিন ইনস্টিটিউট যা পালকি কমিউনিটি সেন্টার নামে পরিচিত। এই কমিউিনিটি সেন্টারের অবকাঠামো অবৈধভাবে উচ্ছেদ করে প্রায় ৬০ লাখ টাকা ক্ষতি হয় রেলের। এ বিষয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি (নং-৫২৯৩/২০০৯) রিট দায়ের করেছেন ছানা উল্লাহ। অথচ, ১৯০৮ সালে গোসাইডাঙ্গা মৌজায় ২৭ দশমিক ১৯ একর ভূমি সাবেক আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের অনুকূলে অধিগ্রহণ করা হয়। যা বর্তমানে আগ্রাবাদ ঢেবা ও ঢেবারপাড় সংলগ্ন ভূমি। আরএস ও বিএস জরীপেও রেলের নামে রেকর্ড চূড়ান্ত সিট রয়েছে। রেলের নামে রেকর্ড ও দখল থাকার পরও বিএস জরিপে ১৮ দশমিক ৯৪ একর জায়গা বন্দরের নামে রেকর্ড করেছে জরিপ কর্মকর্তা। অথচ অবশিষ্ট সাত দশমিক ৫৭ একর রেলের নামে খতিয়ানে অন্তর্ভুক্ত আছে। এ দিকে, মধ্যম হালিশহর মৌজার ১১৫ দশমিক ৬৬ একর জমি বিএস খতিয়ানে বন্দর কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ড হওয়ায় চট্টগ্রাম আদালতের ৩য় যুগ্ম জজ আদালতে একটি মামলা (৪৩/২০০৭) চলমান রয়েছে বন্দরের বিরুদ্ধে। ১৯৯৫ সালের আট নবেম্বর ও চার ডিসেম্বর তারিখে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রেলের মার্শালিং ইয়ার্ড সংলগ্ন ২৪ একর জমিতে যৌথভাবে কন্টেনার ইয়ার্ড স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত আদৌ কার্যকর হয়নি। আরও অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কাস্টমস অকশন শেড নির্মাণের জন্য পাঁচ একর ও কারশেড নির্মাণের জন্য পাঁচ একরসহ মোট দশ একর রেলের জায়গা হস্তান্তরের বিষয়ে ২০০৭ সালের সাত আগস্ট বন্দর ও রেলের মধ্যে যৌথ সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই ভূমির মূল্য ১২ কোটি ৬০ লাখ টাকা বন্দর কর্তৃপক্ষ রেলকে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো পর্যন্ত পরিশোধ করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ দিকে, বিএস জরিপে বন্দরের আশপাশের এলাকায় রেলের মালিকানাধীন ও দখলে থাকা ভূমি বন্দরের নামে রেকর্ড হওয়ার কারণে রেল ও বন্দরের মধ্যে ভূমি বিরোধ শুরু হয়। তবে বন্দরের নিকট হস্তান্তরিত জমির মধ্যে পোর্ট কলোনি এলাকায় রেলের ৩১১টি বাসা রয়েছে। আবার রেলের কাছে হস্তান্তরিত জমিতে বন্দরের ২০৪টি বাসা রয়েছে। এ ছাড়াও বন্দর থানাধীন আগ্রবাদের গোসাইলডাঙ্গা মৌজায় আগ্রাবাদ ঢেবার পাড় এলাকায় রেলের মালিকানাধীন ভূমিতে বন্দর কর্মচারীদের ৮৫টি বাসা রয়েছে। বন্দরের দাবি এসব স্টাফ কোয়ার্টারের গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির বিল বাবদ রেলের কাছে পাওনা প্রায় নয় কোটি টাকা। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা কমিটির এক সদস্য জানিয়েছেন, রেল আমাদের ৬৫ একর জায়গা বুঝিয়ে দিলে আমরা রেলের জায়গা বুঝিয়ে দিব। রেলের কাছে নয় কোটি টাকা উপযোগ বিল পাওনা রয়েছে বন্দরের। রেলের জায়গা আমাদের নামে বিএস হয়েছে। আমরাও খাজনা পরিশোধ করি। গত ২১ জানুয়ারি রেল মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত বৈঠকের রেজুলেশন অনুযায়ী-বন্দরের অংশে থাকা রেল কর্মচারীদের ৩১১টি বাসা ও রেলের অংশে থাকা বন্দর কর্মচারীদের ২০৪টি বাসা আগামী এক বছরে মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় শেষ করা, রেলের অবশিষ্ট ১০৭ টি বাসা থেকে গোসাইলডাঙ্গা এলাকার ৮৫টি বাসা বন্দর নর্থ কলোনিতে স্থানান্তর করে বন্দর কর্তৃপক্ষ রেলকে নিষ্কণ্টক দখল হস্তান্তর করা এবং বাকি ২২টি বাসা রেল কর্তৃপক্ষের আগামী দুই বছরের মধ্যে অন্যত্র স্থানান্তর করার কথা। এ দিকে, বন্দর ইয়ার্ড থেকে রেলের জায়গার ওপর দিয়ে বন্দর কারশেড পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের জন্য রেলকে প্রস্তাব দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সে অনুযায়ী বন্দর কন্টেনার টার্মিনাল থেকে কারশেড পর্যন্ত এবং ভবিষ্যতে রেল কর্তৃক নির্মিতব্য আইসিডি পর্যন্ত দুই হাজার ১৭৮ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৩২ ফুট প্রশস্থ রাস্তা তথা এক দশমিক ৬০ একর ভূমির মালিকানা স্বত্ব¡ রেলের থাকতে হবে। শুধু তাই নয় এই রাস্তা বন্দর ও রেল যৌথ ব্যবহারের শর্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে সড়ক নির্মাণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। রেলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি দফতর সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে এবং বন্দর একীভূত থাকাকালীন সময়ে দশটি মৌজায় প্রায় ৯২১ একর ভূমি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সালে বিভিন্ন ভূমি অধিগ্রহণ মামলার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য দশটি মৌজায় ৯২১ দশমিক ২৪ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৬০ সালে অধিগ্রহণকৃত এই ভূমির মধ্যে সম্পত্তি অধিগ্রহণ কমিটির সিদ্ধান্ত মতে ৩৫৩ একর ভূমি রেলওয়ের ও ৫৬৮ দশমিক ২৪ একর চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রাপ্য হয়। এ বিষয়ে ১৯৮৩ সালের ১৬ আগস্ট রেল ও বন্দরের মধ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আবার ১৯৯৫ সালের এক নবেম্বর ও নয় নবেম্বর বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর ২০০১ সালের ২২ ডিসেম্বর আরেক দফায় অমীমাংসিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ দিকে, ১৯৯৫ সালের আট নবেম্বর ও চার ডিসেম্বর এবং ১৯৯৮ সালের ১৩ আগস্ট আয়োজিত বৈঠকে বন্দর এক্সেস এলাকায় সাত দশমিক ২৫ একর, আইওডব্লিও ও পিডব্লিওআই এ্যানক্লেব (বন্দর সংরক্ষিত এলাকায়) তিন দশমিক ৩১ একর, পোর্ট এক্সেস রোড গেট সম্প্রসারণের জন্য এক দশমিক আট একর এবং রেলওয়ে ট্রেনিং একাডেমি এলাকায় এনসিটি প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য ২২ দশমিক ১৮ একর, বন্দর সাউথ কলোনিতে দশ দশমিক ৩০ একর এবং বাংলা বাজার এলাকায় এক একরসহ মোট ৪৫ দশমিক ১২ একর রেলভূমি বন্দরের উন্নয়নে রেলের পক্ষ থেকে হস্তান্তর করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গত ২১ জানুয়ারি রেল মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে রেল সচিব মোফাজ্জল হোসেনের সভাপতিত্বে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
×