ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের ৪২ ভাগই পথচারী

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতের ৪২ ভাগই পথচারী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মাগুরার রাঘবদাইড় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী মিনু খাতুন। পরীক্ষা শেষে রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে চলন্ত ট্রাকের চালক মিনুর চুল ধরে টান দেয়! এতে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলে তার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। মুহূর্তের মধ্যে নিভে যায় একটি তাজা প্রাণ। একটি সম্ভাবনা। ঘটনা বিদায়ী বছরের ছয় ডিসেম্বরের। জানা গেছে, ঘটনার পর মামলা হলেও চালক এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে! তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন হলো এই হত্যাকা-ের বিচার আদৌ হবে কিনা। কতদিনই বা অপেক্ষা করতে হবে বিচারের। পরিসংখ্যান বলছে, পথচারী মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। দেশে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ৪২ ভাগের বেশি পথচারী! যা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। জানা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আশাবাদী হওয়ার কোন খবর নেই। দুর্ঘটনা রোধে নানামুখী পদক্ষেপের কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই সহনীয় মাত্রায় নামিয়ে আনার চ্যালেঞ্জও নিয়েছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দুর্ঘটনার পরিমাণ বেড়েছে অন্তত ১৫ থেকে ২২ ভাগ পর্যন্ত। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, বিদায়ী বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা মোট জিডিপির দুই ভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসচেতনতার অভাব, পথচারী চলাচলের জন্য ফুটপাত ও সড়ক দখলে থাকা, ব্যাপকভাবে পরিবহন বৃদ্ধি, দক্ষ চালকের অভাব, আইন না মানা, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, অবৈধ চালকের দৌরাত্ম্য, বিচারহীনতা ও কঠিন দ-ের অভাব, সরকারী নজরদারি কম, সড়কে প্রকৌলশগত ত্রুটি, লক্কর-ঝক্কর ও অনুমোদনহীন পরিবহনসহ নানা কারণে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ছে দুর্ঘটনা ॥ নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রকাশিত সর্বশেষ দুর্ঘটনা প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে সারা দেশে ৩ হাজার ৪৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৬ নারী ও ৫৩৯ শিশুসহ মোট ৪ হাজার ২৮৪ জন নিহত এবং ৯ হাজার ১১২ জন আহত হয়েছেন। ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৯৮টি দুর্ঘটনায় ৪৭০ নারী ও ৪৫৩ শিশুসহ ৩ হাজার ৪১২ জন নিহত এবং ৮ হাজার ৫৭২ জন আহত হয়েছেন। ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৫৯২টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬ হাজার ৮২৩ ও ১৪ হাজার ২৬। নিহতের মধ্যে ৭৮১ নারী ও ৭৬২ শিশু রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির দুই শতাংশ বলে জানানো হয়। ১৪ দফা সুপারিশ ॥ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৪টি সুপারিশ উত্থাপন করা হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে। সেগুলো হচ্ছে- যেকোন ধরনের যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস বাধ্যতামূলককরণ। চালক ও সহকারীসহ সব ধরনের পরিবহন কর্মীদের নিয়োগপত্র ও শ্রম আইন মেনে মজুরি-ভাতা প্রদান এবং তাদের শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ। সব বাস-ট্রাক টার্মিনাল, টেম্পোস্ট্যান্ড, দূরপাল্লার রুটে অবৈধ চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। বেসরকারী উদ্যোগে বাস আমদানি উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানি ও চাঁদাবাজি বন্ধ এবং রুট পারমিট প্রাপ্তি সহজীকরণ। অবৈধ-ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সারা বছর বিআরটিএর অভিযান এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা। ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানোর দায়ে চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীর সঙ্গে মালিককেও আইনের আওতায় আনা। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য দায়ী চালকের মৃত্যুদ-, সহকারীর যাবজ্জীবন কারাদ- ও আহতের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং হতাহত পরিবারকে মালিকের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের আইন প্রণয়ন। এছাড়াও অন্যান্য সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে, সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলো নিয়মিত সংস্কার, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো চিহ্নিতকরণ এবং সতর্ক সংকেত স্থাপন। ট্রাফিক আইন অমান্যকারী চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। নসিমন -করিমনসহ স্থানীয়ভাবে তৈরি ক্ষুদ্র যানবাহন ও অটোটেম্পো, হিউম্যান হলার চলাচলের ওপর নজরদারি বৃদ্ধি এবং এ ধরনের যানবাহনের চালক ও সহকারির লাইসেন্স বাধ্যতামূলককরণ। বিআরটিসিকে শক্তিশালীকরণ ও রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রুটসহ দেশের সকল আন্তঃজেলা রুটে বিআরটিসির সার্ভিস চালু। বিআরটিসির বাস ব্যক্তি বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে ইজারা প্রদানের প্রথা বাতিল এবং বিআরটিসির বাস চলাচলে বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ। সরকারের উদ্যোগে মালিক-শ্রমিক সংগঠন, সংশ্লিষ্ট বেসরকারী সংস্থাসমূহের সমন্বয়ে চালকসহ পরিবহন শ্রমিকদের সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা, সব ধরনের যানবাহনে ‘যাত্রীবীমা’ এবং চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীদের জীবনবীমা বাধ্যতামূলককরণ। পথচারী মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে ॥ ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের হার বেড়েছে বলে জানিয়েছে যাত্রী অধিকার আদায়ে নিয়োজিত সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি। মোট দুর্ঘটনার মধ্যে পথচারী চাপা দেয়ার সংখ্যা সবচেয়ে উদ্বেগজনক। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গঠিত দুর্ঘটনার ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পথচারীকে চাপা, ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১১ দশমিক ৯ শতাংশ খাদে পড়ে, ২ দশমিক ৮ শতাংশ চাকায় ওড়না পেছিয়ে সংগঠিত হয়। বিগত ২০১৬ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে ২২ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ দুর্ঘটনা ও আহতের হার ১ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত ও ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছে। বাৎসরিক সড়ক দুর্ঘটনা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ছোট-বড় ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে সর্বমোট ২৩ হাজার ৫৯০ জন যাত্রী, চালক, পরিবহন ও শ্রমিক হতাহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে জিডিপির প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ। এ সময় ১ হাজার ২৪৯টি বাস, ১ হাজার ৬৩৫টি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান, ২৭৬টি হিউম্যান হলার, ২৬২টি কার, জীপ ও মাইক্রোবাস; ১ হাজার ৭৪ টি অটোরিক্সা, ১ হাজার ৪৭৫টি মোটরসাইকেল, ৩২২টি ব্যাটারি চালিত রিক্সা, ৮২৪টি নছিমন-করিমন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সংগঠিত দুর্ঘটনার ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ পথচারীকে চাপা, ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১১ দশমিক ৯ শতাংশ খাদে পড়ে, ২ দশমিক ৮ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে সংগঠিত হয়। সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে, সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো হচ্ছে- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপজ্জনক অভারটেকিং, রাস্তা-ঘাটের নির্মাণ ক্রটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেডফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে পরা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকায় রাস্তার মাঝ পথে পথচারীদের যাতায়াত। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী বলেন, উন্নয়নশীল দেশে সড়ক দুর্ঘটনার মাত্রা সবচেয়ে বেশি। গবেষণায় দেখা গেছে মূলত চার কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হয়। এসব কারণ কারও অজানা নয়। সকলের সম্মিলিত চেষ্টা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সঙ্কট সমাধান করতে পারে বলেও মনে করেন তিনি। সড়ক দুর্ঘটনার দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ গোটা বিশ্বের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে নৌ ও রেলপথ উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ নৌপথ ও রেলপথ সড়ক থেকে নিরাপদ। কিন্তু আমাদের দেশে হচ্ছে উল্টো। দিন দিন নৌপথ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। রেলপথের পরিধি মোটেই বাড়ানো যাচ্ছে না। উন্নত করা যাচ্ছে না সেবার মান। সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, এই ব্যবস্থার দিকে না গেলে আমরা মোটেই সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারব না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে যথাযথ আইন মেনে গাড়ি চলাচলের প্রবণতা কম। যারা আইন মানে না তারা তো বেপরোয়া হবেই। অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলেও মনে করেন এই গবেষক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নৌ, সড়ক ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কিছুতেই সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর বিষয়টি এড়াতে পারেন না। সড়কগুলোয় যেমন নিরাপত্তা নেই তেমনি ফুটপাতেও নেই। ফুটপাত ব্যবহার করতে না পেরে সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটেন, আর তখনই দুর্ঘটনার শিকার হন তারা। বিআরটিএ সচিব শওকত আলী বলেন, সুনির্দিষ্ট একটি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা হচ্ছে না। অনেক কারণ রয়েছে। এজন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাছাই করে একে একে সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয় হলো দুর্ঘটনা একটি বড় সমস্যা। বিআরটিএ মন্ত্রণালয় কিংবা সরকার কারও একার পক্ষে এই সমস্যা সমাধান করা কঠিন। এজন্য সমন্বিত চেষ্টা প্রয়োজন। সবার আগে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। আমরা তো সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য।
×