ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা

প্রকাশিত: ০৬:১৯, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮

ভাষা

ঝলমলে আলোগুলোর দিকে অভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিন্তি। এমন আলো যে সে আগে কখনও দেখেনি, তেমনটি নয়। ঢাকায় থাকলে এমন আলো না দেখে থাকা সম্ভব নয়। ঢাকার বাসিন্দারা এতে অভ্যস্ত। তবুও বাণিজ্যমেলার এই রংবেরঙের আলো মুগ্ধ করে প্রিন্তিকে। কারণটা সে নিজেও জানে না। মামণির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে প্রিন্তির নজর কাড়ল বিশাল বড় ভারতীয় প্যাভিলিয়ন। আর প্রিন্তির মনের কথা বুঝেই কী না, মামণি ওকে নিয়ে সেখানে ঢুকলেন। ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট দোকান। হরেক রকম জিনিসের সমাহার। একটা দোকানে একজন ভারতীয় লোক দাঁড়িয়ে আছেন। উনি গণিতবিদ। অঙ্কের সিডি বিক্রি করছেন। সেখানে গিয়ে অঙ্কের পদ্ধতিগুলো ভারি পছন্দ হলো প্রিন্তির। মামণি বললেন, ভাল লাগলে নিয়ে নাও। কাজে দেবে। দোকানের লোকটাকে একটা সিডি দিতে বলতেই লোকটা তার পাশে দাঁড়ানো প্রিন্তির বয়সী মেয়েটিকে দেখিয়ে দিল। ইংরেজীতে বলল, ওর কাছ থেকে নিয়ে নাও। প্রিন্তি মেয়েটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে ও প্রিন্তির হাতে প্যাকেট করা সিডি তুলে দিয়ে হিন্দী ভাষায় একটা কিছু বোঝাতে শুরু করল। হিন্দী ভাষাটার এখন বাংলাদেশেও খুব চল। মেয়েটা হয়ত এজন্যই এ ভাষায় কথা বলছে। কিন্তু হিন্দী ভাষাটা প্রিন্তির অজানা। তাই সে বিনয়ের সঙ্গে মেয়েটিকে বলল যে সে হিন্দী বোঝে না। ইংরেজীতে কথা বললে তার খুব সুবিধা হবে। -হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মেয়েটি দ্রুত জবাব দেয়। তার কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে সে ইংরেজীতে পারদর্শী। প্রিন্তি ইংরেজীতেই জিজ্ঞেস করল, কিছু মনে না করলে জানতে পারি তুমি ভারতের কোথা থেকে এসেছ? ইংরেজী মাধ্যমে পড়ার সুবাদে ইংরেজী বলাটা তার জন্য কঠিন নয়। মেয়েটি হাসল। শুদ্ধ ইংরেজীতে বলল, আমি বাংলাদেশী। প্রিন্তি অবাক হয়। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই জানে প্রিন্তি বাংলাদেশী। সে তো তাকে বাংলা বলতেও শুনেছে। কিন্তু কেন সে হিন্দী বলছিল? আর এখনই বা কেন ইংরেজীতে কথা বলছে? সে তো বাঙালী। বাংলা বললেই তো হয়। এসব কথা জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি বিরক্ত হয়ে ইংরেজীতেই জবাব দিল, এখন তো হিন্দীরই যুগ! প্রিন্তি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। একজন বাঙালী হয়ে ও কীভাবে এমন কথা বলছে? এ-ও কী সম্ভব? তবে কী রফিক, শফিউর, সালামদের রক্তের কোন মর্যাদাই নেই? তবে কি ভাষা আন্দোলন আর ভাষা শহীদদের কোন গুরুত্বই নেই? প্রিন্তির চোখ ভিজে আসে। সে দ্রুত ওখান থেকে সরে আসে। মামণির যেন কী কী জিনিস কেনার ছিল। কিন্তু প্রিন্তির জন্য তা সম্ভব হলো না। সে কোনভাবেই এখান থাকতে চাচ্ছে না। বাসায় যাব, বাসায় যাব- করছে। অগত্যা মামণি ওকে নিয়ে ফটকের দিকে পা বাড়ালেন। ওরা যখন ফটক দিয়ে বের হচ্ছে, তখন চোখে পড়ল এক বিদেশী পরিবারকে। তারা ভেতরে ঢুকছে। সাদা চামড়ার মানুষ ওরা। বাবা-মা আর মেয়ে। মেয়েটির বয়স ১১ কী ১২। প্রিন্তির মতোই হবে। বিদেশী দেখলে বাংলাদেশের মানুষের এমনিতেই এক ধরনের কৌতূহল হয়। প্রিন্তির তেমনটা হয় না। ওরা তো সাধারণ মানুষই। জীবজন্তু তো আর না। কিন্তু আজ প্রিন্তি ওদের দেখে থমকে দাঁড়াল। ওই মেয়েটি পরিষ্কার বাংলায় তার বাবাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘এই জায়গাটার নামটা যেন কী?’ হাঁ করে দাঁড়িয়ে পড়ে প্রিন্তি। তারপর ছুটে যায় ভিনদেশী কিশোরীটির দিকে। হতভম্ব হয়ে পেছনে পড়ে থাকেন মামণি। ‘তুমি বাংলা বলতে পার!’ কিছুক্ষণের জন্য শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে সরাসরি মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়েই প্রথমে এই কথাটি জিজ্ঞেস করল প্রিন্তি। উত্তেজনায় তার গলা কেঁপে যাচ্ছে, সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, চোখের পাতা দ্রুত নড়ছে। মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে প্রিন্তির দিকে তাকাল। তারপর স্মিত হেসে বলল, বাংলাদেশে আসব আর বাংলা শিখব না? তা কি কখনও হয়? প্রিন্তি বলল, কিন্তু অনেকেই তো শেখে না, তেমন কোন অসুবিধা তো হয় না। মেয়েটা বলল, হয়ত তোমার কথাই ঠিক। তবে বাংলা হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র ভাষা যার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে, শুধু মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য। এমন নজির বিশ্বের আর কোথাও নেই। এ ভাষা শিখতে পারা, এ ভাষায় কথা বলতে পারাও তো গৌরবের ব্যাপার। আমি ছোট্টবেলা থেকেই বাংলার কথা শুনে এসেছিলাম। তখন থেকেই ইচ্ছে ছিল এ ভাষাটা শিখব, বাঙালী জাতিকে কাছ থেকে দেখব, সেই বীর জাতিকে, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিতেও কার্পণ্য করেনি। তারপর চার বছর টানা পরিশ্রম করে শুদ্ধ বাংলায় কথা বলা আয়ত্তে আনতে পেরেছি। আমার কী যে ভাললাগছে! উচ্ছ্বসিতভাবে শেষ কথাটি বলে মেয়েটা। প্রিন্তি কিছু বলতে পারে না। কী আশ্চর্য! এ কেমন বৈপরীত্য! প্রায় একই বয়সী দুজন কিশোরী। একজন বাংলাদেশী, একজন বিদেশী। একজনের মাতৃভাষা বাংলা, অপরজনের অন্য কোন ভাষা। অথচ বাঙালী হয়েও সেই দোকানের মেয়েটি নিজের ভাষাকে ভালবাসতে পারেনি। ভাষাকে সে শুধু অসম্মানই করেছে। মাতৃভাষা তার কাছে অতি তুচ্ছ। সে বরং অন্য ভাষায় কথা বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সে জানে না কীভাবে ভাষাকে ভালবাসতে হয়, সম্মান করতে হয়। নিজের ভাষায় কথা বলাটা যে সবচেয়ে বড় গৌরব, তা তার জানা নেই। তার কাছে অন্য ভাষায় কথা বলতে পারাটাই গর্বের বিষয়। আর অন্যদিকে তারই মতো আরেকটি মেয়ে, বাংলা যার মাতৃভাষা নয়, বাংলার সঙ্গে যার কোন সম্পর্কই নেই- সে উপলব্ধি করতে পেরেছে এর গুরুত্ব। তাই তো ছোটবেলা থেকেই সে স্বপ্ন দেখে এসেছে এ ভাষা শেখার, এ ভাষায় কথা বলার। শুধু স্বপ্ন দেখেই সে ক্ষান্ত হয়নি, সত্যি সত্যি পরিশ্রম করে শিখেছেও এই বাংলা ভাষা। সে বাংলাকে যথাযথ সম্মান দিয়েছে। সম্মান দেখিয়েছে ভাষা শহীদদের। বাংলায় কথা বলতে পেরে মেয়েটি গর্বিত বোধ করছে। সব মিলে প্রকৃতপক্ষেই বাংলা ভাষাকে ভালবাসতে পেরেছে সে, একজন বাঙালী হয়েও যা পারেনি প্রায় তারই সমবয়সী আরেকটি মেয়ে। বাংলা যার মায়ের ভাষা, সে পারেনি বাংলাকে এভাবে সম্মান দিতে। পারেনি তার ভাষাকে ভালবাসতে। প্রিন্তি আনমনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবনার জগতে ডুবে আছে সে। কখন যেন মামণি এসে তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। মামণি আর সেই ভিনদেশী মানুষগুলো অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল প্রিন্তির দুই চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। অশ্রুজলে সিক্ত চোখে প্রিন্তি উদ্দেশ্যহীনভাবে তাকিয়ে আছে। চারপাশের রঙিন আর উজ্জ্বল আলো পড়ে তার চোখের কোণ চিকচিক করছে। যেন সাগর থেকে তুলে আনা কোন ঝিনুকের বুকে সত্যিকারের মুক্তা ঝিকমিক করছে। ভিকারুননিসা নুন স্কুল এ্যান্ড কলেজ একাদশ শ্রেণি (ইংলিশ ভার্সন) অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×