ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বিশিষ্টজনদের অভিমত

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৬ জানুয়ারি ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজন সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সড়ক দুর্ঘটনা ফের বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীসহ বিশিষ্ট নাগরিকেরা বলেছেন, গণপরিবহন খাতের নৈরাজ্য এবং শ্রমিক অসন্তোষ দূর করা না গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দরকার নৌপথ, সড়কপথ ও রেলপথের মধ্যে সমন্বয় করে একটি সমন্বিত গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এজন্য সুপরিকল্পিত প্রকল্প প্রণয়ন এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান-গবেষণাসহ রুট অনুযায়ী গাড়ি চলাচলের পরিমাণ নির্ধারণে সরকারীভাবে দুর্ঘটনা গবেষণা সেল গঠনেরও পরামর্শ দেন বক্তারা। শুক্রবার সকালে রাজধানীর পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনে অনুষ্ঠিত ‘সড়ক দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও প্রতিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তারা এসব কথা বলেন। বেসরকারী সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি এই সভার আয়োজন করে। জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে। সভায় বক্তারা বলেন, মূলত চার কারণে বাংলাদেশে ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক বেশি। সড়ক দুর্ঘটনার দিক বিবেচনা করলে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যে কোন মূল্যে এই ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এজন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন বক্তারা। বক্তারা বলেন, সড়কের পাশাপাশি নৌ ও রেল সেক্টরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেয়া উচিত। কারণ সড়কের চেয়ে নৌ-রেলপথে দুর্ঘটনা কম। আলোচনা সভায় বক্তারা আরও বলেন, সাধারণ মালিকদের হয়রানি বন্ধ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যায্য মজুরি-ভাতা দেয়া না হলে এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা মোটেও সম্ভব নয়। এজন্য ঢাকাসহ সারাদেশের বাস-ট্রাক টার্মিনালগুলোকে চাঁদাবাজিমুক্ত এবং চালক ও সহকারীসহ সব ধরনের পরিবহনকর্মীদের নিয়োগপত্র দিতে হবে। দৈনিক জনকণ্ঠ’র জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ও জাতীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক রাজন ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুর রহমান সেলিম, পরিবেশবিদ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী, বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভুঁইয়া প্রমুখ। আলোচনা সভায় আশীষ কুমার দে তার প্রবন্ধে সড়ক দুর্ঘটনার গত তিন বছরের মাস-ভিত্তিক পরিসংখ্যান ও পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন তুলে ধরেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৭ সালে সারাদেশে ৩ হাজার ৪৭২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫১৬ নারী ও ৫৩৯ শিশুসহ মোট ৪ হাজার ২৮৪ জন নিহত এবং ৯ হাজার ১১২ জন আহত হয়েছেন। ২০১৬ সালে ২ হাজার ৯৯৮টি দুর্ঘটনায় ৪৭০ নারী ও ৪৫৩ শিশুসহ ৩ হাজার ৪১২ জন নিহত এবং ৮ হাজার ৫৭২ জন আহত হয়েছেন। ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৫৯২টি দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬ হাজার ৮২৩ ও ১৪ হাজার ২৬। নিহতের মধ্যে ৭৮১ নারী ও ৭৬২ শিশু রয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনায় বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৪ হাজার কোটি টাকা বা জিডিপির দুই শতাংশ বলে জানানো হয়। প্রবন্ধে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৪টি সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। সেগুলো হচ্ছে- যেকোন ধরনের যানবাহনের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস বাধ্যতামূলককরণ। চালক ও সহকারীসহ সব ধরনের পরিবহনকর্মীদের নিয়োগপত্র ও শ্রম আইন মেনে মজুরি-ভাতা প্রদান এবং তাদের শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ। সকল বাস, ট্রাক, টার্মিনাল, টেম্পুস্ট্যান্ড, দূরপাল্লার রুটে অবৈধ চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ। বেসরকারী উদ্যোগে বাস আমদানি উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পর্যায়ে হয়রানি ও চাঁদাবাজি বন্ধ এবং রুট পারমিট প্রাপ্তি সহজীকরণ। অবৈধ-ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি ও লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সারা বছর বিআরটিএ’র অভিযান ও ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা। ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালানোর দায়ে চালক, সুপারভাইজার ও সহকারীর সঙ্গে মালিককেও আইনের আওতায় আনা। দুর্ঘটনায় প্রাণহানির জন্য দায়ী চালকের মৃত্যুদন্ড-, সহকারীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড- ও আহতের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং হতাহত পরিবারকে মালিকের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের আইন প্রণয়ন। এছাড়াও অন্যান্য সুপারিশসমূহের মধ্যে রয়েছে, সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কগুলো নিয়মিত সংস্কার, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো চিহ্নিতকরণ এবং সতর্ক সংকেত স্থাপন। ট্রাফিক আইন অমান্যকারী চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ।
×