ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

চার স্তরে বাস্তবায়িত হবে মাস্টারপ্ল্যান

সারাদেশে রেল যোগাযোগে আড়াই লাখ কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭

সারাদেশে রেল যোগাযোগে আড়াই লাখ কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ সারাদেশে ট্রেন যোগাযোগে আড়াই লাখ কোটি টাকার কর্মযজ্ঞ চলছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে। যুগান্তকারী এই পদক্ষেপ কার্যকর হলেই কয়েকটি স্থান ছাড়া প্রায় সারাদেশেই ট্রেনে যাতায়ত সম্ভব হবে। চারটি স্তরে প্রতিটি পাঁচ বছর মেয়াদী এই মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন করা হবে ২০৩০ সাল পর্যন্ত। মোট ২৩৫টি প্রকল্পের মাধ্যমে এই মাস্টারপ্লান বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে চলছে রেল মন্ত্রণালয়। এতে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত ও পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ, সারাদেশে ডুয়েল গেজ রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের সরাসরি ট্রেন যোগাযোগ, বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে রেল সেতু নির্মাণ, যমুনা নদীর উপর বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি এলাকায় আরেকটি রেল সেতু নির্মাণ এবং পদ্মা নদীর উপর আরও একটি রেল সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে এই ২০ বছর মেয়াদী এই মাস্টারপ্লানে। এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বুধবার জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রতি অর্থবছরে রেল যোগাযোগের উন্নয়নে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছেন। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৪টি ধাপে এই মহাউন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আমারা কাজ করে যাচ্ছি। এই মাস্টারপ্লান সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে সারাদেশে ট্রেনে যাত্রীসেবা যেমন বাড়বে ও পণ্য পরিবহন সুযোগ পাবে ব্যবসায়ীরা। এতে দেশের প্রায় সব জেলা রেল নেটওয়ার্কের আওতায় চলে আসবে। এক কথায় উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ রেলওয়ে স্পেয়ার্স এ্যান্ড এক্সেসরিজ সাপ্লাইয়ার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ফেরদৌস হুদা চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, এই উন্নয়নে তথা যাত্রী ও পরিবহন সেবা অক্ষুণ্ন রাখতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা এফবিসিসিআই অর্ন্তভুক্ত রেলের একমাত্র এই রেজিস্টার্ড প্রতিষ্ঠান। ২০৪ জন সরবরাহকারী ও আমদানীকারক প্রতি অর্থবছরে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার ৩৫ হাজার বিভিন্ন স্পেয়ার্স ও এক্সেসরিজ সরবরাহ করে আসছেন। রেলের তথা যাত্রী সেবায় এবং পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে আমদানীকারক ও সরবরাহকারীদের ভূমিকা রেল উন্নয়নের আরেক অংশীদার। রেল মন্ত্রণালয়ের তথ্যে প্রকাশ পেয়েছে, ২০ বছর মেয়াদী রেলের এই মাস্টারপ্লান যুগান্তকারী উন্নয়নের পদক্ষেপ। বর্তমান সরকারের আমলে গত সেশনে যেমন রেলের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা উন্নয়নের গতিধারায় সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দিয়েছিলেন। তেমনিভাবে আগামী নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোট সরকার পুনরায় নির্বাচিত হলে রেলের উন্নয়নের গতিধারা আরও ব্যাপক আকারে বৃদ্ধি পাবে। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের নেতৃত্বে ও নির্দেশনায় রেল মন্ত্রণালয় দীর্ঘ প্রায় ২০ বছরের মাস্টারপ্লান হাতে নিয়েছেন। এ মাস্টারপ্লানের আওতায় চলমান প্রকল্পসহ মোট ২৩৫টি প্রকল্প রয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য ছাড়াও সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর এই প্রথম কোন স্টিল অবকাঠামোর বৃহত্তম রেল সেতু নির্মাণ করল রেল কর্তৃপক্ষ। মেঘনা নদীর উপর তৈরি করা এই দ্বিতীয় ভৈরব সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৮৪ মিটার। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিস্তা নদীর উপর ২১৮ মিটার দৈর্ঘ্যের তিতাস সেতু। এ দুটি স্টিল কাঠামোর সেতু ও সংযোগ রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৯৫৯ দশমিক ২০ কেটি টাকা। ২০২০ সালে আখাউড়া-লাকসাম ডাবল লাইন প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই রেলপথে আরও দুই ঘণ্টা সাশ্রয় হবে এবং পুরোদমে এসব সেতুর ফলপ্রসূতা পাওয়া যাবে। গত ৯ নবেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এই সেতু দুটি উদ্বোধন করেন। ইরকন-এফকন’স জেভি এবং গ্যানন এফএলসিএফ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এই সেতুর ফাউন্ডেশন নির্মাণ করেছে। ইন্টারন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন ইকুইপমেন্ট এই সেতুর ফাউন্ডেশন নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছে । এ রুটে ৮৪টি ট্রেন চলাচলে আরও কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাবে এমন আশা করছেন কর্তৃপক্ষ। নতুন এই প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে- প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা-কুমিল্লা কর্ডলাইন নির্মাণ, ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা নদীর উপর বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি রুটে আরেকটি রেল সেতু নির্মাণ, ১ হাজার ৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা নদীর উপর আরেকটি রেল সেতু নির্মাণ, ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে রেল সেতু নির্মাণ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বৈদ্যুতিক রেলপথ চালু, খুলনা-পার্বতীপুরে ৮ হাজার ৬শ কোটি টাকা ব্যয়ে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ, আখাউড়া-সিলেটের মধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকায় ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প এই যুগান্তকারী মাস্টারপ্লান অনুযায়ী অগ্রাধিকার পাচ্ছে। এছাড়াও রাজধানীর চারপাশে এলিভেটেড সার্কুলার রেলপথ নির্মাণ, জয়দেবপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত ডাবল লাইন রেলপথ, বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ, সান্তাহার-বগুড়া-কাউনিয়া রেলপথকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প। মহাজোট সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে রেলের উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। সে অনুযায়ী যাত্রীর সেবার মান বাড়ানোসহ চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে কন্টেইনারবাহী ওয়াগন বৃদ্ধির জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে তাগিদ দেয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে ২০ বছর মেয়াদী এই মাস্টারপ্লান বাস্তবায়নের কাজ চলছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রেল উন্নয়নে প্রথম ধাপের ৫ বছর মেয়াদী মাস্টারপ্লানে ২০১১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রকল্প উন্নয়নে ১০৩টি প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রায় শেষ পর্যায়ে। এছাড়া সরকারী অর্থায়নে ৩১টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজও চলছে। তবে এছাড়াও বৈদেশিক অর্থায়নে বাস্তবায়িত হবে ৩৪টি প্রকল্প। ১০৩টি প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপের প্রকল্প ২০১৬ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০২০ সালের অর্থবছরে ৪৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে রেলের উন্নয়ন করার নক্সা রয়েছে। সরকারী অর্থায়নে এর মধ্যে ২৫টি প্রকল্প প্রায় ৯ হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ও বৈদেশিক অর্থায়নে ২৩টি প্রকল্প ১৯ হাজার ১১৩ কোটি টাকা ব্যয় হবে বাস্তবায়িত হবে। এই ৪৮টি প্রকল্পের মোট ব্যয় হবে প্রায় ২৮ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। তৃতীয় ধাপের মাস্টারপ্লান অনুযায়ী ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের অর্থবছরে ৩৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই প্যাকেজে ৪৩ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা এসব প্রকল্পে ব্যয় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চতুর্থ ধাপে মাস্টারপ্লান অনুযায়ী ২০২৬ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫ বছরে আরও ৩৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ৩৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে জানায় রেল মন্ত্রণালয় সূত্র। ২০ বছর মেয়াদী মাস্টারপ্লানে উন্নয়নের যে গতিধারা রয়েছে সে অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে চলমান প্রকল্পগুলো আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, ভারতীয় ঋণ, জাপানী ঋণ মওকুফ সহায়তা তহবিল, কোরিয়ান ঋণ মওকুফ তহবিল ও অন্যান্য উন্নত দেশের আর্থিক সহায়তায় এই প্রকল্পগুলো। এছাড়া দেশীয় বেসরকারী বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকলে বিদেশী দাতা সংস্থাদের পাশাপাশি দেশীরাও ভূমিকা রাখবে। সরকার রেলের উন্নয়নে ও দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ চালু করে জনগণকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। রেলের এমন উন্নয়ন আগামীর জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে।
×