ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মানব পাচারের মূল নায়ক তানভীরকে পুলিশে দিলেন সাংসদ

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭

মানব পাচারের মূল নায়ক তানভীরকে পুলিশে দিলেন সাংসদ

আজাদ সুলায়মান ॥ অবিশ্বাস্য কায়দায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েই সংসদ সদস্যের পুত্র ও এপিএস পরিচয়ে বিদেশে বিপুলসংখ্যক মানব পাচার করা হয়েছে। পাসপোর্ট অধিদফতর, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইমিগ্রেশনের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চাঞ্চল্যকর এই মানব পাচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা একটি টেলিভিশন ও জনকণ্ঠে ফাঁস হওয়ায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। এ ঘটনার মূল নায়ক তানভীর হোসেন মিয়াকে ডেকে পুলিশে সোপর্দ করেছেন অভিযুক্ত সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া চৌধুরী। শেরেবাংলা নগর পুলিশ তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তার প্রতারণায় ইতোমধ্যে যারা জাপানের ভিসা পেয়েছেন- তারা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে সেজন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনে বিশেষ সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে ৮ জনের নাম ঠিকানাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ইমিগ্রেশনের নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে। এছাড়া রবিবার মানব পাচারের এ ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে র‌্যাবসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। র‌্যাব পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, র‌্যাব এ ধরনের অভিযোগ বেশ গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত করে। এদিকে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সিলেট ২ আসনের সাংসদ ইয়াহিয়া চৌধুুরীর সঙ্গে গত ৬ অক্টোবর যে কজন তার এপিএস ও স্বজন পরিচয়ে জাপান গেছেন, তাদের প্রত্যেকের নাম ঠিকানা সংগ্রহ করেছে পাসপোর্ট অধিদফতর। কিভাবে তারা পাসপোর্ট তৈরি করেছে, কোন কোন কর্মকর্তা ও কর্মচারী তাদেরকে সহযোগিতা করেছে সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পাসপোর্ট অধিদফতর। এ বিষয়ে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের একজন প্রভাবশালী প্রশাসনিক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেছেন, পাসপোর্ট শুধু ঢাকা আগারগাঁও হেড অফিসেই তৈরি করা হয় না। এখন দেশের প্রতিটি জেলায় পাসপোর্ট তৈরি করা হয়। এখন দেখতে হবে এ ঘটনায় অভিযুক্তরা কোন অফিসের মাধ্যমে পাসপোর্ট তৈরি ও সংগ্রহ করেছে। পুুলিশ জানিয়েছে, জানা যায় আটক তানভীর হোসেন মিয়াকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। এ ঘটনার মূল নায়ক হিসেবে সেই ঢাকায় জাপান দূতাবাস থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ভিসা সংগ্রহ করে। ইভেন্ট ৭১ নামের তার একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তার অফিস বারিধারায়। জাপানে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে তানভীর প্রথমে আমন্ত্রণ জানান সাংসদ ইয়াহিয়া চৌধুরীকে। গত ৬ অক্টোবর সাংসদের সঙ্গে তিনিও একই ফ্লাইটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে জাপান যান। আবার একই সঙ্গে দুদিন পর ফিরে আসেন। তখনও সাংসদ জানতে পারেননি ওই একই ফ্লাইটে তার এপিএস ও ছেলে পরিচয়ে আরও দুজন জাপান গেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাংসদ ইয়াহিয়া চৌধুরী নিজেকে এই প্রতারণার একজন ভিকটিম দাবি করে জনকণ্ঠকে বলেন, এ ঘটনা একটি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার আগ পর্যন্ত জানতে পারা দূরের কথা শুনতেই পারিনি। প্রকৃতপক্ষে আমার দুটো ছেলে লন্ডনে বসবাস ও পড়াশোনা করে। কেন আামি জাপানে মানব পাচারের মতো অপরাধ করব। আমার কি টাকা আয়ের সুযোগ কম? টিআর কাবিখা উন্নয়ন, টেন্ডার ও কেনাকাটা করার মতো অনেক সুযোগই আছে। আমি তো ওই সব জায়গা থেকে কখনও কোন পয়সা কামাই করিনি। এখন তাহলে জেনে শুনে আদম পাচারের মতো জঘন্য অপকর্ম কেন করতে যাব। তাহলে আপনার নামে এই অভিযোগ কেন করা হলো প্রশ্ন করা হলে ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন, এ ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি যে, আমি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য স্বউদ্যোগে ওই ক্রিমিনাল তানভীর হোসেন মিয়াকে কৌশলে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি। শনিবার ময়মনসিংহের এক এমপি তুহিনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের ন্যাম ভবনে তানভীরকে ডেকে আনি। তারপর সেখানে পুলিশ ডেকে এনে তাকে সোপর্দ করি। এখন পুলিশ তদন্ত করে করুক। এ ধরনের জালিয়াতির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতাকে দায়ী করে তিনি বলেন, গত রমজানে আমার মাকে নিয়ে ওমরাহ করার জন্য এমপি হিসেবে নোট ভারবালের জন্য আবেদন করেছিলাম। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আমাকে তা প্রত্যাখান করে সুস্পষ্ট ভাষায় আইন দেখিয়ে বলেছে, এটা শুধু সাংসদের জন্য। তার মাকে দেয়া যায় না। তাহলে আমার এপিএস বা সন্তান পরিচয়ে কাউকে নোট ভারবাল দেয়ার আগে আমাকে কেন একবারও জিজ্ঞাসা করেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? এ ঘটনার পর থেকে আমার এপিএস মাইনুল ইসলাম মানুকে বাদ দিয়ে দিয়েছি। ইমিগ্রেশনে ও চেক ইন কাউন্টারে কি লক্ষ্য করেননি আপনার ছেলে ও এপিএস পরিচয়ে সফর সঙ্গী রয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কাছে তো কেউই জানতে চায়নি কার কি পরিচয়। শুধু তানভীরের দাওয়াতে আমি জাপান গিয়েছি, সে শুধু আমার ফ্লাইট ভাড়া ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে ওই সাংস্কৃতিক টিমের নামে। শুধু আমি তো নই, সে তো আরও ক’জন এমপিকে একই কায়দায় নিয়ে গেছে। তানভীরের সঙ্গে পরিচয় প্রসঙ্গে সাংসদ ইয়াহিয়া চৌধুরী বলেন, বছর দেড়েক আগে বাসায় এসে নিজেকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোক পরিচয় দিয়ে দেশে বিদেশে ইভেন্ট করার কথা জানায়। তানভীর তখন আরও অনেক এমপিকে বিদেশে পাঠানোর উদাহরণ দিয়ে আমার পাসপোর্ট নেয়ার চেষ্টা করত। শেষ পর্যন্ত জাপানের আমন্ত্রণে রাজি হই। বিমানবন্দরে গিয়ে আমি ভিআইপি কাউন্টার দিয়ে যাই। সে সাধারণ কাউন্টার দিয়ে গেছে। তখন সে আমার পিএস পরিচয় দিয়েছে কিনা তাতো আমার জানা কথা নয়। উল্লেখ্য গত ৬ অক্টোবর রাত দু’টায় শাহজালাল এয়ারপোর্ট দিয়ে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটে জাপানে রওনা হন সিলেট-২ আসনের সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া চৌধুরী। তার সঙ্গে একই ফ্লাইটে জাপান গেছেন, তার ব্যক্তিগত সহকারী পরিচয়ে তানভীর হোসেন মিয়া, চট্টগ্রামের সাংসদ মাহফুজুর রহমানের ছেলে পরিচয়ে মাহিন রহমান ও তার এপিএস পরিচয়ে বিদ্যুত মল্লিক। একইভাবে জালিয়াতির মাধ্যমে বরিশাল ৩ আসনের সাংসদ টিপু সুলতানের ছেলে পরিচয়ে ভিসা পেয়েছেন, নুরনবী সুলতান ও এপিএস পরিচয়ে নাহিদ। এছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে ভিসার জন্য আবেদন করেছেন, ভোলার সংসদ সদস্য আলী আজমের ছেলে পরিচয়ে রায়হান আজম, চট্টগ্রামের মুস্তাফিজুর রহমানের ছেলে পরিচয়ে জাহিদুর রহমান, ময়মনসিংহের সাংসদ আনোয়ার আবেদীন খানের ছেলে পরিচয়ে আয়মান আবেদীন খান, কক্সবাজারের সাংসদ আশিক উল্লাহ রফিকের ছেলে পরিচয়ে আরাফাত উল্লাহ ছানী। সাংসদ আনোয়ার আবেদীন খান তুহিনও এ জালিয়াতির শিকার দাবি করে বলেন, আমার ছেলে আয়মান আবেদীন খানের নামে একটি পাসপোর্টের ফটোকপি আমাকে দেখানো হয়। তাতে দেখা যায় আমার ছেলের নাম পিতা মাতা ঠিক আছে কিন্তু বয়স ও চেহারা ঠিক নেই। আমার ছেলে আয়মানের বয়স ১০, কিন্তু নকল পাসপোর্টে তার বয়স লেখা ২৮। এটা জানার পরই তানভীরকে বাসায় ডেকে এনে ররিবার পুলিশকে সোপর্দ করি। আসলে তানভীর একটা পেশাদার প্রতারক ও জালিয়াতের হোতা। সেসব সময় এমপি হোস্টেলে ঘুর ঘুর করত আর সুযোগ খুঁজত। এ জালিয়াতির শিকার অপর সংসদ সদস্য বরিশাল ৩ আসনের টিপু সুলতান বলেন, এই মাসেই হঠাৎ একদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এনএসআই-এর এক কর্মকর্তা আমাকে প্রথমে অবহিত করেন। ওই কর্মকর্তা জানতেন আমার কোন ছেলে নেই। তাহলে কিভাবে আমার ছেলে পরিচয়ে ভিসার জন্য আবেদন করা হয়। আমি তাৎক্ষণিক থানায় গিয়ে জিডি করি, জাপান দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে অবজেকশন দিই। তানভীরের সঙ্গে পরিচয় প্রসঙ্গে টিপু সুলতান বলেন, বছর খানেক আগে সে একদিন পার্লামেন্টে আমার পিএসের মাধ্যমে কথা বলে পরিচয় দেয়। সে বিদেশে ইভেন্টে আমন্ত্রণ জানালে আমি বলে দিই দেশেই ঘুরার সময় পাই না। বিদেশ যাব কখন। তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। তারপর হঠাৎ শুনি এই কাহিনী। এ বিষয়ে শেরে বাংলা থানার ওসি গণেশ গোপাল বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, তানভীর হোসেন মিয়ার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট আইন ও প্রতারণার দন্ড বিধিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। তাকে জেলে পাঠানো হয়েছে। রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করা যাবে।
×