ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ॥ উন্নয়ন যাত্রায় তৃণমূলের নারী -পপি দেবী থাপা

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭

বাংলাদেশ ॥ উন্নয়ন যাত্রায় তৃণমূলের নারী  -পপি দেবী থাপা

সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে বালাদেশের নারী। শক্ত হাতে তারা ধরছে দেশের অর্থনীতির হাল। যুগ যুগ ধরে চলে আসা সমাজ সৃষ্ট কুসংস্কার আর নিজেকে গুটিয়ে রাখার সমস্ত জড়তা জাল ছিন্ন করে নারী আজ দেশের উন্নয়নের সমান অংশীদার। বাংলার নারী আজ তার কর্মের জন্য প্রশংসিত সারা বিশ্বে। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক থেকে প্রান্তিক সকল পর্যায়েই নারী তার কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি পাচ্ছে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্স ২০১৭ এর তথ্য অনুসারে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বালাদেশে লিঙ্গ বৈষম্যের হার সবচেয়ে কম। এ ইনডেক্স অনুসারে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭ নম্বরে। এ বছরের ইনডেক্স তৈরি করা হয়েছে চারটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে- অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ, শিক্ষাবিষয়ক অর্জন, স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর হার এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। যা দেশের অর্থনীতিতে নারীর উত্তরণকেই প্রমাণ করে। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই তৃণমূলের নারীরাও। উচ্চ শিক্ষা যাদের জোটেনি, এসএসসি দেয়ার আগেই যাদের সংসারে প্রবেশ করতে হয়েছে অথবা সামান্য অক্ষর জ্ঞানটুকুতেই থেমে গেছে শিক্ষার গতিপথ। পারিবারিক অসচ্ছলতা বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠিত স্থান ছোঁয়ার পথে তারাও আজ থেমে নেই। পাবনার নার্গিস। অসচ্ছলতা, অজ্ঞানতার কারণে তার বাবা-মা তাকে ১৬ বছর বয়স না হতেই বিয়ে দেয়। বিয়ের এক বছর না ঘুরতেই এক কন্যা সন্তানের জননী সে। মেয়ের বয়স যখন সাড়ে চার স্বামী অন্যত্র বিয়ে করে তাকে ছেড়ে যায়। গরিব বাবা-মা এর পরিবারে তার ফেরার পথও খোলা নেই। তাই বলে থেমে থাকেনি নার্গিস ও তার মেয়ের জীবন। দিনমজুরির টাকা থেকে অন্ন সংস্থানের পর বেঁচে যাওয়া সামান্য অর্থ দিনে দিনে জমিয়ে সেলাই মেশিন কিনে দোকানের অর্ডারি কাপড় সেলাই করে আজ সে সচ্ছল। নারীর দৃঢ় মনোবল, কর্মস্পৃহা আর পরিশ্রমই তার অবস্থানকে শক্তিশালী করছে। ২০১১ এর আদমশুমারি অনুসারে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ২৩ লক্ষ ১৯ হাজার। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩৪%। পুরুষের সংখ্যা ৭ কোটি ১২ লাখ ৫৫ হাজার আর নারী ৭ কোটি ১০ লাখ ৬৪ হাজার। মোট জনসংখ্যার ৪৯ ভাগ নারী। সুতরাং সকল পর্যায়ের নারীর অংশগ্রহণ ব্যতীত জাতীয় উন্নয়ন অসম্ভব। সে কারণে তৃণমূলের নারীরা দিনমজুরের কাজ থেকে শুরু করে দোকান করা, ব্যবসা, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প , কারখানার শ্রমিক, কৃষিকাজ, সেলাই করা, কাগজের ঠোঙা বা প্যাকেট বানানো, ইমিটেশনের গহনা বানানোর কাজ করছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং নিয়ে মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান, হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ ইত্যাদি পেশায় নিযুক্ত থেকে নিজ সংসার তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। বাগেরহাটের সবিতা নিজেই দেখাশোনা করেন ২টি মাছের ঘের। তার এ বাড়তি আয় সাংসারিক সচ্ছলতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১০ অনুযায়ী দেশে মোট ৫.৪১ কোটি শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় কর্মরত রয়েছেন। এর মধে নারী ১.৬২ কোটি। সরকারীভাবে বালাদেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান ২০ শতাংশ। নারীরা যে গৃহস্থালি কর্ম করেন তার অর্থমূল্য আনুমানিক আড়াই লাখ কোটি টাকা। সে হিসেবে নারীর অবদান দাঁড়ায় ৪৮ শতাংশ। গত সাত বছরে এক্ষেত্রে নারীর আবদান আরও বেড়েছে নিশ্চিতভাবেই। পোশাক শিল্প খাতেও বাংলার নারীর আজ জয় জয়কার। দেশের মোট রফতানি আয়ের ৭০ শতাংশের বেশি আসে পোশাক শিল্প খাত থেকে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপিতে শিল্প খাতের অবদান ৩১.২৮ শতাংশ। দেশে নারী পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা ৩০ লাখ। যাদের প্রায় সবাই তৃণমূল পর্যায়ের নারী। দেশের নারীরা এখন অর্থনৈতিক, সামাজিক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশেও। সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে গত ১০ বছরে গড়ে প্রায় ৫ লাখ বালাদেশী নারী শ্রমিক বিভিন্ন পেশায় চাকরি নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। দেশে পাঠাচ্ছেন মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এ ছাড়াও তৃণমূলের নারীরা এলাকার ধান ও গম ভাঙানোর মিলে কাজ করে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটাচ্ছে। কৃষি কাজেও পিছিয়ে নেই বাংলার নারী। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৪.৭৯ শতাংশ। কৃষিই বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। মাঠে ফসল রোপণ থেকে শুরু করে সার দেয়া, আগাছা দমন, কীটনাশক ছিটানো, ফসল কাটা এবং তা মাথায় নিয়ে ঘরে পৌঁছানো সকল কাজেই নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। বাড়ির পাশে পড়ে থাকা জায়গা বা উঠোনে শাক-সবজি ও ফলমূলের চাষ করে সংসারে বাড়তি রোজগারের একটা পথ করে নিচ্ছে অনেকেই। খুলনার ষৈলো রংপুর, বিল ডাকাতিয়া এসব অঞ্চলের অনেক নারীর কৃষি কাজে রয়েছে ব্যাপক অংশগ্রহণ। এ ছাড়াও দক্ষিণাঞ্চলের চিড়িংচাষ, শুঁটকি, হাঁস-মুরগি পালনে নারীর অবস্থান দৃৃশ্যমান। এতে করে নিজ পরিবারের পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতি হচ্ছে চাঙ্গা। দেশের পূর্বাঞ্চলে চা শিল্পের সমৃদ্ধির পেছনেও রয়েছে পাহাড়ী নারী চা শ্রমিকের অবদান। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোন পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির হিসাব না থাকায় পুরুষ শ্রমিকের সমপরিমাণ কাজ করেও কৃষি খাতে নারী শ্রমিকের বৈধ পরিচিতি নেই। থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নারীর অবদানের হার আরও বেড়ে যেত। তৃণমূলের নারীরা এখন কৃষি কাজের পাশাপাশি স্বল্প পুঁজির ব্যবসাও করছে। নওয়াপাড়ার বাজারে মহিলা মুড়ি বিক্রেতার সংখ্যা কম করে হলেও ১৮ জন। গ্রাম থেকে মুড়ি নিয়ে তারা এ বাজারে বিক্রি করেণ। এই মুড়ি বিক্রির আয় থেকেই চলে তাদের সংসার। কেউ বাড়ির পাশেই স্বল্প পরিসরে দিচ্ছে মুদিদোকান। কেউবা চা-এর। কুষ্টিয়ার চা বিক্রেতা হাসির আয় থেকেই চলে তার সংসার। দিনাজপুরের লিপিসহ অনেকের পরিবার চলে হাতে বানানো পাঁপড় বিক্রির অর্থে। কুমারখালীর নারীদের বানানো কাপড়ের হস্তশিল্প বিক্রির টাকায় স্বাবলম্বী অনেক নারী। যশোরে নারীরা নকশিকাঁথা সেলাই করে হচ্ছে আর্থিকভাবে সচ্ছল। ঝিকরগাছার ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সে অঞ্চলের অনেক মহিলা। গাজীপুরের ফারহানা আর সাভারের সাজেদার মতো অনেক মহিলাই ট্রেনিং নিয়ে পোলট্রি ব্যবসাকেই তাদের পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। টাঙ্গাইলের ময়নার মতো দেশের অনেক নারীর সংসার চলছে ঠোঙা বিক্রির টাকায়। এই প্রান্তিক নারীদের উৎপাদিত অনেক পণ্যই দেশের সীমানা পেরিয়ে রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। আয় করছে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা। এটি বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে প্রান্তিক নারীদের অংশগ্রহণ আনবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এ লক্ষ্য অর্জনে সরকারের আন্তরিকতা আর নানা বাস্তবমুখী পদক্ষেপের সুফল দেখা যাবে অচিরেই। যথাযথ প্রশিক্ষণ লাভের মাধ্যমে এই প্রান্তিক নারীরাই হয়ে উঠবেন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অন্যতম সহায়ক শক্তি। অতীতে যেমন আমাদের তৃণমূলের নারীরা নিজ মেধা, আত্মবিশ্বাস আর যোগ্যতা নিয়ে শূন্য থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে নির্মাণ করেছেন নিজেদের পথ তেমনি অর্থ আয়ের মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা পিছিয়ে থাকবেন এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। সময়ের দাবি মিটিয়ে এভাবেই এগিয়ে চলেছে আমাদের দেশের নারী। এই এগিয়ে চলা যে কেবল বর্তমান উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে তাই নয়, এর রয়েছে সুদূরপ্রসারী প্রভাব। নিজ যোগ্যতায় ভাগ্য বদলে নেয়া, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত এই সংগ্রামী নারীরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছেন শিক্ষার গুরুত্ব। তাই সন্তানদের শিক্ষার বিষয়েও তারা সচেতন। সামান্য হলেও আর্থিক নিশ্চয়তা থাকায় সন্তানদের শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের ভূমিকা রাখার সুযোগ এখন অনেক বেশি এবং তারা সে ভূমিকা পালন করছেন যথাযথ। এভাবেই কেবল বর্তমান নয় জাতির ভবিষ্যত নির্মাণেও তারা পালন করছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। তৃণমূলের নারী শক্তির জাগরণের মধ্যেই নিহিত বাংলার সামাজিক ও আর্থিক উন্নতি। এ উন্নয়নই জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে নজরুলের সাম্যের বাংলায় দিক্ষীত করে রবিঠাকুরের সোনার বাংলা গড়ে তুলবে।
×