ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীতে বড় ধরনের;###;নাশকতার পরিকল্পনা;###;ছিল ওদের

নব্য জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা তামিমের সেকেন্ড ইন কমান্ডসহ গ্রেফতার ৩

প্রকাশিত: ০৫:০৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭

নব্য জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা তামিমের সেকেন্ড ইন কমান্ডসহ গ্রেফতার ৩

শংকর কুমার দে ॥ জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শীর্ষ জঙ্গী নেতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান তামিম চৌধুরীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আব্দুস সামাদ ওরফে আরিফ মামু ওরফে আশিক, তার শ্বশুর জিয়াদুল ইসলাম এবং আজিজুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান ওরফে শিশিরন এই তিন দুর্ধর্ষ জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিন জঙ্গীকে গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে একটি ৯ এমএম পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি ও ২০০ ডেটোনেটর। রাজধানী ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীরা বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল বলে পুলিশের দাবি। তিন জঙ্গীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নব্য জেএমবি ও তামিম চৌধুরী সম্পর্কে যে নতুন তথ্য পাওয়া গেছে যা চাঞ্চল্যকর। জিজ্ঞাসাবাদে জঙ্গীরা জানিয়েছে, ২০১৪ সালে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে ‘জুনদ আল তাওহীদ আল খিলাফাই’ নামে একটি সংগঠন গড়ে গ্রেফতারকৃত সামাদ। নারায়ণগঞ্জে জঙ্গীবিরোধী অভিযানে নিহত তামিম চৌধুরী ছিল সংগঠনটির প্রধান আর সামাদ ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’। বোমা তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে পারদর্শী সামাদ সংগঠনের জন্য সদস্য ও অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখত বলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের দাবি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানিয়েছে, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গীবিরোধী অভিযানে জঙ্গীসংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতারা গ্রেফতার ও নিহত হলে নব্য জেএমবি জঙ্গী সংগঠনের নেতৃত্বে আসে গ্রেফতার হওয়া সামাদ এবং তার নেতৃত্বেই জঙ্গী সংগঠনটি সংগঠিত হয়ে আবারও বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করে। নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতা তামিম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে গ্রেফতার হওয়া সামাদ রাজধানীর কল্যাণপুর ও মিরপুর এলাকায় প্রায় ডজনখানেক জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। গুলশান হলি আর্টিজান হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী সোহেল মাহফুজ ওরফে হাতকাটা মাহফুজ গ্রেফতার হওয়ার পর জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল গ্রেফতার হওয়া এই সামাদই। বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মহাখালী এলাকায় অভিযান চালিয়ে আব্দুস সামাদ ওরফে আরিফ মামু ওরফে আশিক, তার শ্বশুর জিয়াদুল ইসলাম এবং মোঃ আজিজুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান ওরফে শিশিরকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার পুলিশের গণমাধ্যম কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সামাদের বাড়ি দিনাজপুরে। ২০০২ সালে দাওরা হাদিস এবং ২০১১ সালে ফাজিল পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে। ২০১০ সালে সে জেএমবিতে যোগ দেয়। ২০১৪ সালে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে মিলে ‘জুনদ আল তাওহীদ আল খিলাফাই’ নামে একটি সংগঠন গড়ে সামাদ। তামিম ছিল সংগঠনটির প্রধান আর সামাদ ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’। সামাদ সংগঠনের জন্য সদস্য ও অর্থ সংগ্রহের পাশাপাশি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখত। অস্ত্র চালনা ও গ্রেনেড ব্যবহারের বিষয়ে সংগঠনের নবীন সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিত আব্দুস সামাদ। নব্য জেএমবির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা বিভিন্ন সময় গ্রেফতার ও নিহত হওয়ার পর তার নেতৃত্বে সংগঠনটির কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ হয় বলে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধানের দাবি। এর আগে গত জুনে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল বলেছিলেন, ‘আইয়ুব বাচ্চু’ ছদ্মনাম নিয়ে এক ব্যক্তি জঙ্গী দল নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টায় আছে বলে পুলিশ তথ্য পেয়েছে। সাভার ও লক্ষ্মীপুর থেকে নব্য জেএমবির সন্দেহভাজন তিন সদস্যকে গ্রেফতারের পর সে সময় গণমাধ্যমের কাছে এক ব্রিফিংয়ে মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, আইয়ুব বাচ্চু তার সাংগঠনিক নাম। তার একটি ছবি আমরা পেয়েছি। তার প্রকৃত নাম- পরিচয় জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে পুলিশ খুঁজছে। পরের মাসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার একটি সন্দেহজনক জঙ্গী আস্তানা থেকে তিন নারীকে গ্রেফতারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ওই তিন নারীর মধ্যে আরশিদা ওরফে আশরাতি জাহান তিথি, নব্য জেএমবির আমির আইয়ুব বাচ্চু ওরফে সাজিদ হাসান সজীবের স্ত্রী। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়া সামাদের সঙ্গে বাকি দু’জনের মধ্যে সামাদের শ্বশুর জিয়াদুল ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে নব্য জেএমবির জন্য অস্ত্র-বিস্ফোরক ও ডেটোনেটর সংগ্রহের পাশাপাশি সংরক্ষণ ও বিতরণের দায়িত্ব পালন করতেন বলে পুলিশের দাবি। আর আজিজুল ইসলাম মেহেদী পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই বছর ধরে জঙ্গী কার্যক্রমে যুক্ত হয়ে জিহাদ প্রশিক্ষণ নিয়েছে। আব্দুস সামাদ ওরফে মামুর বাড়ি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে। তবে বেশিরভাগ সময় সে নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় থাকত। নওগাঁর সাপাহারের একটি বাসায় থেকে সে পড়াশোনা করেছে। জিয়াদুল ও আজিজুলের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জে। গ্রেফতার হওয়া জিয়াদুল ইসলাম ও সামাদ সম্পর্কে শ্বশুর-জামাতা। সে অস্ত্র ও বিস্ফোরক রাখতে সামাদ ওরফে মামুকে সহায়তা করত। আর আজিজুল বছর দুই আগে কথিত জিহাদের নামে ঘর ছাড়ে। তারা দু’জন স্বল্পশিক্ষিত। তামিমের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় মামু ॥ গ্রেফতার হওয়া জঙ্গী নেতা সামাদের জঙ্গী সংগঠনের সাংগঠনিক ছদ্মনাম ‘মামু’। নারায়ণগঞ্জে নিহত তামিম চৌধুরীর সঙ্গে জঙ্গী নেতাদের পরিচয় করিয়ে দেয় গ্রেফতার হওয়া সামাদ ওরফে মামু। নব্য জেএমবির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে চিহ্নিত জঙ্গী আব্দুস সামাদ ওরফে মামু বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহম্মেদ চৌধুরীকে নব্য জেএমবি সংগঠিত করতে মূল সমন্বয়কের ভূমিকায় কাজ করে। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর ঢাকায় আসার পর দেলোয়ার মিস্ত্রি ও শরিফুল ইসলাম খালিদের মাধ্যমে তামিমের সঙ্গে পরিচয় হয় মামুর। পরবর্তীতে মামুর মাধ্যমে তারা জুনুদ আল তাওহীদ আল খলিফা নামে প্রথমে একটি সংগঠন তৈরি করে। সেখানে আনসার আল ইসলামের কিছু সদস্য যোগ দেয়। কিন্তু ২০১৪ সালে সেই সংগঠন বিলুপ্ত করে নব্য জেএমবি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করে তামিম। তাকে জেএমবির পুরাতন সদস্য মামুনুর রশিদ রিপন ও সরোয়ার জাহানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় আব্দুস সামাদ মামু। মামু সে সময় থেকেই তামিমের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে কাজ করে। বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয় নব্য জেএমবির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড আব্দুস সামাদ ওরফে মামু ও তার শশুর জিয়াদুল ইসলাম ও আজিজুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান ওরফে শিশিরকে। মাছের খামারে পানির নিচে লুকিয়ে রাখত ডেটোনেটর ॥ আব্দুস সামাদ ওরফে মামু কওমি মাদ্রাসা থেকে দাওরা হাদিস ও আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাস করে। সে আরবী ভাষায় অনেক দক্ষ ছিল। নব্য জেএমবিকে সংগঠিত করার পর মামু বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়ে মোটিভেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিত। এছাড়া একই সঙ্গে নব্য জেএমবির অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহে অন্যদের সহায়তা করত। সামাদ ওরফে মামুর শ্বশুর জিয়াদুল ইসলামের মাছের খামারে পানির নিচে তারা ডেটোনেটর লুকিয়ে রাখত। পরবর্তীতে চাহিদামতো তা নির্দিষ্ট স্থানে সরবরাহ করত। তিন জঙ্গীকে রিমান্ডে আনা হবে ॥ গ্রেফতার হওয়া তিন জঙ্গীকে রিমান্ডে আনা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। সামাদ ওরফে মামুকে গুলশানের হোলি আর্টিজান হামলার আগে উত্তরবঙ্গে সদস্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করা হয়। এজন্য সামাদ ওরফে মামু প্রথম দিকে ঢাকায় অবস্থান করলেও পরবর্তীতে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় অবস্থান নেয়। সামাদ ওরফে মামুসহ তিন জঙ্গীকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তামিম চৌধুরী সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানে সামাদ ওরফে মামু। তাকে রিমান্ডে এনে তার কাছ থেকে নিহত তামিম চৌধুরী সম্পর্কে বাংলাদেশে অবস্থানের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানার চেষ্টা করবে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। জঙ্গীসংগঠন নব্য জেএমবি কোনঠাসা ॥ পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি বর্তমানে কোণঠাসা অবস্থায়। তাদের নতুন করে বড় ধরনের কোন হামলা করার শক্তি বা সামর্থ্য নেই। তাদের বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ হিসেবে যারা কাজ করত তাদের প্রায় সবাইকে গ্রেফতার করা হয়েছে বা বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। তবে সংগঠনের যেসব নেতাকর্মী এখনও আত্মগোপনে রয়েছে তারা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে এই পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
×