ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

তারেকের নির্দেশেই শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলা চালানো হয়

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ১৩ নভেম্বর ২০১৭

তারেকের নির্দেশেই শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলা চালানো হয়

বিকাশ দত্ত ॥ স্পর্শকাতর ও বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা দুটি মামলায় আসামিদের মধ্যে জঙ্গী মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি দুটি জবানবন্দী পেশ করেন। সেই জবানবন্দীতে অজানা অনেক দুর্ধর্ষ লোমহর্ষক কাহিনী উঠে এসেছে। জবানবন্দীতে মুফতি হান্নান বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশেই শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রশাসনিক ও আর্থিক সহযোগিতায় এ হামলা চালানো হয়। শেখ হাসিনা জীবিত থাকলে এই দেশের মুসলমানদের ও সাধারণ জনগণের শান্তি আসবে না। তাই ২১ আগস্টের জনসভা সম্পর্কে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তারেক সাহেব আমাকে (তারেক রহমান) বলেন যে, আপনারা বাবর সাহেব ও আব্দুস সালাম পিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করবেন, তারা আপনাদের সকল প্রকার সহায়তা করবে। তারেক রহমানের নির্দেশেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের প্রশাসনিক ও আর্থিক সহযোগিতায় এ হামলা চালানো হয়। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় ২৪ জন নিহত ও নেতাকর্মী-আইনজীবী-সাংবাদিকসহ পাঁচ শতাধিক লোক আহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পতœী আইভি রহমান। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হামলা থেকে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচ- শব্দে তার শ্রবণশক্তিতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দও এই গ্রেনেড হামলা থেকে বেঁচে যান। রাজধানীর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ মামলার বিচার চলছে। মামলায় চীফ প্রসিকিউটরকে যুক্তিতর্কে সহায়তায় রয়েছেন এ্যাডভোকেট মোশারফ হোসেন কাজল, এ্যাডভোকেট খন্দকার আবদুল মান্নান, এ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান, এ্যাডভোকেট আকরাম উদ্দিন শ্যামল, এ্যাডভোকেট ফারহানা রেজা প্রমুখ। এই হামলায় জড়িত থাকার দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় ১২ জন আসামি ১৩টি জবানবন্দী পেশ করেছেন। আসামিদের মধ্যে জঙ্গী মুফতি আব্দুল হান্নান মুন্সি দুটি জবানবন্দী পেশ করেন। নিম্নে ওই দুটি জবানবন্দী তুলে ধরা হলো। ২০০৭ সালের ১ নবেম্বর রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান মাহমুদ, এসিএমএম, ঢাকা তার নিকট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে মুফতি হান্নান বলেন, আমি স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী করিতেছি যে, আমি ১৯৭৯ সনে গহরডাঙ্গা মাদ্রাসা হইতে কোরান হেফজ শেষ করি। তারপর একই বৎসর আমি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ১৯৮৭ ইং পর্যন্ত পড়াশোনা করি এবং টাইটেল পাস করি। একই বৎসর পাকিস্তানের করাচীর জামেয়া বিন নূরীয়া কওমী মাদ্রাসা হইতে মুফতি কোর্স সম্পন্ন করি। ওই বৎসরই ১৯৭৯ সনে রমজানের ছুটিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মুজাহিদদের পক্ষে আফগানিস্তানের খোশত শহরে প্রথমে ১৫ দিনের সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং ১৫ দিন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা কালে আমার বাম হাতে মিসাইলের আঘাতে মারাত্মক যখমপ্রাপ্ত হই। ওই অবস্থায় আমাকে পেশোয়ার কুয়েত আল হেলাল হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। চিকিৎসা শেষে আবার করাচী গিয়ে আমি শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করি। ১৯৯২ সনের ডিসেম্বর মাসে আমি দেশে ফিরি এবং কোটালীপাড়ায় আদর্শ ক্যাডেট মাদ্রাসা স্থাপন করি। একই সঙ্গে আল ফারুক ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে একটি জনসেবামূলক এনজিও প্রতিষ্ঠা করি। ১৯৯৪ সনে হরকত-উল জিহাদ ইসলামীর আমির মুফতি শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি মুফতি আব্দুল হাই ও আব্দুর রউফ গফরডাঙ্গা মাদ্রাসায় আসেন। যাহারা সাংগঠনিক সভা করেন। তখন তাহারা আমাকেও ডাকেন। তখন তাহারা একটি জেলা কমিটি গঠন করেন, আমাকে থানা কমিটির প্রচার সম্পাদক করা হয়। অতঃপর ২০০০ ইং সনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান কলেজ ময়দানে ২১ জুলাই তারিখে এক জনসভার জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ২১ ও ২২ জুলাই তারিখে দুই ড্রামভর্তি তথাকথিত বিস্ফোরকদ্রব্য পাওয়া যায়। যাহাতে কোন ডেটোনেটর ছিল না। যাহার একটি ৭৬ কেজি, দ্বিতীয়টি ৮২ কেজি ওজনের ছিল। ওই সময়ে আমাকেসহ আরও ৩০০ লোকের বিরুদ্ধে প্রাথমিক মামলা করা হয়। আমার ভাই, ভগ্নিপতি ও বোনকে তখন গ্রেফতার করিয়া ১২ দিন হাজতে রাখা হয়। তৎকারণে আমি গা ঢাকা দিয়ে ঢাকার বাড্ডার আনন্দনগরে প্রকৌশলীর বাসায় ৪র্থ তলায় বাসা ভাড়া নিই। অতঃপর আহসান উল্লাহ কাজল হরকত-উল জিহাদ ইসলামীর ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ডিআইটিতে কর্নেল সাহেবের বাসায় ৪তলা বিশিষ্ট বাসার ৩য় তলায় ভাড়া নেয়। তথায় মাওলানা মোসাদেক বিল্লাহ একটি মক্তব পরিচালনা করিতেছে। তাহারই একটি কক্ষে উক্ত আহসান উল্লাহ কাজ করিতেন। পরবর্তীতে পশ্চিম মেরুলে আহসান উল্লাহ কাজল আর একটি বাসা ভাড়া নেয়। সেখানে লিটন, হাসান, ওমর ফারুক, আবুবকর যাতায়াত করিত। অতঃপর শাইখুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকসহ ৩০০ ওলামাগণকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাবস্থায় গ্রেফতার করে এবং বিভিন্ন সময়ে আলেমগণকে হয়রানি করে এবং ফতোয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তৎকারণে মাওলানা তাহের যিনি হরকত-উল জিহাদ আল ইসলামীর ঢাকা মহানগরের সভপাতি তাহার ঢাকা মহানগরী অফিস মোহাম্মদপুর সুপার মার্কেটের সন্নিকটে নিচতলার একটি ভাড়া বাড়িতে। ১৮/০৮/০৪ ইং তারিখে আমাকে ও আহসান উল্লাহ কাজলকে মাওলানা আবু তাহের ডাকেন এবং উক্ত সুপার মার্কেটে সাক্ষাত করিতে বলেন। আমরা তথায় গিয়া সকাল ১০টায় সাক্ষাত করি। তখন তিনি আমাকে বলেন যে, আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে পরামর্শ করিয়াছি এবং আব্দুস সালাম পিন্টু (তৎকালীন উপমন্ত্রী)-এর সহিত আমরা বৈঠক করিয়াছি। তাহাতে ২১ আগস্ট ২০০৪ ইং তারিখে শেখ হাসিনার জনসভায় হামলা করিয়া তাহাকে মারিয়া ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইয়াছে। অতঃপর আমাকে ও আহসান উল্লাহ কাজলকে আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসায় ধানম-ির লেকপাড় লইয়া যাওয়া হয়। উক্ত বাসায় ঢুকিয়া বাম পাশের একটি কক্ষে আমাদিগকে বসিতে দেয়া হয়। প্রথমে তাহার ভাই মাওলানা তাজউদ্দীনের সহিত আমাদের দেখা হয় এবং আমাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করা হয়। উক্ত অবস্থায় আব্দুস সালাম পিন্টু সাহেব তথায় উপস্থিত হন। মাওলানা আবু তাহের তখন আমাকে ও কাজলকে পরিচয় করান। কুশল বিনিময়ের পর তিনি বলেন যে, আমি গোপালগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী সত্ত্বেও আমাকে সেখানে মিটিংয়ে নামিতে দেয়া হয় নাই। বিভিন্ন সময়ে আলেমগণকে হয়রানিমূলক জেল দেয়া হইয়াছে এবং কুকুরের মাথায় টুপি পরানো হইয়াছে। তাই শেখ হাসিনা জীবিত থাকিলে এই দেশের মুসলমানদের ও সাধারণ জনগণের শান্তি আসিতে পারিবে না। তাই ২১ আগস্টের জনসভা সম্পর্কে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হইয়াছে, তদনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হত্যা না করা পর্যন্ত শান্তি হইবে না। এই বিষয়ে যাহা কিছু প্রয়োজন সবকিছুর ব্যবস্থা আমি আবু তাহেরের মাধ্যমে করিব। তখন তিনি আমাদের সামনে আবু তাহেরের উপরোক্ত বিষয়ে জনশক্তি এবং অর্থ সংস্থানের বিষয়ে সার্বিক প্রয়োজন মেটানোর আশ^াস প্রদান করেন। যে কোন ধরনের সমস্যার সমাধান এবং প্রশাসনিক সহায়তার ব্যবস্থা তিনি গ্রহণ করিবেন মর্মে তখন আশ^াস প্রদান করেন। অতঃপর আমি ও আহসান উল্লাহ কাজল তথা হইতে চলিয়া যাই। পরদিন মাওলানা তাহের, আহসান উল্লাহ ও আবু জান্দালকে মিরপুর ১নং পানির ট্যাঙ্কির কাছে মসজিদে আকবর কমপ্লেক্সের নিকটে যাইতে বলেন। তথায় আব্দুস সালাম পিন্টু সাহেব তাহার সার্বিক কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত ও করণীয় কাজের ধরন বর্ণনাপূর্বক আবু জান্দাল ও কাজলকে নির্দেশনা দেন এবং জনসভাস্থলে যাহারা হামলার দায়িত্ব পালন করিবে তাহাদের নামের তালিকা দেন এবং ২০/৮/০৪ইং তারিখে তাহাদিগকে পিন্টু সাহেবের বাসায় যাইতে বলেন। তদনুযায়ী ২০ তারিখে সকাল ১১টার দিকে জান্দাল ও কাজল পিন্টু সাহেবের বাসায় যায়। তখন আব্দুস সালাম পিন্টু ও তাহার ভাই মাওলানা তাজউদ্দীন তাহেরের উপস্থিতিতে হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড জান্দাল ও কাজলকে দেয় এবং আবু তাহের খরচ বাবদ জান্দাল ও কাজলকে ২০,০০০/- টাকা দেয়। তখন আবু তাহের বলেন যে, তিনি ২১/৮/০৪ইং তারিখ সকালে বাড্ডার বাসায় অফিসে আসিবেন। বাকি সিদ্ধান্ত তখন তথায় অর্থাৎ বাড্ডায় গ্রহণ করা হইবে। আমি আহসান উল্লাহ কাজলের নিকট হইতে জানি যে, আব্দুস সালাম পিন্টু শেখ হাসিনার ২১ তারিখের জনসভায় হামলার জন্য ৬ জন লোক দেবেন। তখন পিন্টু কাজলকে উক্ত ৬ জনের একজনের সহিত পরিচয় করান। অতঃপর আহসান উল্লাহ কাজল ও মাওলানা আবু তাহেরের তালিকা অনুযায়ী সকলকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংবাদ দেয়া হয়। পরে ২১ তারিখে সকাল ৮টার আগে-পরে হামলার জন্য ধার্যকৃত অধিকাংশ লোক বাড্ডার বাসায় (কাজলের বাসায়) উপস্থিত হয় এবং সেখানে আবু তাহেরও হাজির হয়। পরে আমি, তাহের ও কাজল বলি যে, যাহাদের দাড়ি আছে তাহারা হামলায় যাইতে পারিবে না। তাহের সাহেবের নির্দেশে আমি উপরোক্ত মতে বলিয়াছি। তালিকা মতে তখন আহসান উল্লাহ কাজল, আবু জান্দাল (নড়াইল), হাসান (মোহাম্মদপুর, ঢাকা কলেজের ছাত্র), ওমর ফারুক (ধানম-ি, ঢাকা কলেজের ছাত্র), আবু বক্কর (ফরিদপুর), জুয়েল (নারায়ণগঞ্জ), শুভ (নারায়ণগঞ্জ), ফেরদাউস (মিরপুর), রতন (ঝিনাইদহ), মাসুদ (ঝিনাইদহ), আবুল কালাম আজাদ (রাজশাহী), ইকবাল (ঝিনাইদহ), জাহাঙ্গীরকে (কুষ্টিয়া) হামলার দায়িত্ব দেয়া হয়। উক্ত তালিকার বাহিরে আমি কিছু লোককে আসিতে বলি। কিন্তু তাহারা আসে নাই। ইহা ছাড়াও আরও কিছু সাংগঠনিক সদস্য তখন বাড্ডায় উক্ত অফিসে উপস্থিত হয়। তাহাদিগকে লইয়াও তখন বিভিন্ন আলোচনা হয়। অতঃপর তালিকাভুক্ত হামলাকারীগণকে জনসভার অবস্থান বুঝিয়া ও ফিল্ডের পরিস্থিতি বুঝিয়া এবং গোলাপশাহ মাজার মসজিদে অবস্থানকারী অপর ৬ জনের সহিত পরামর্শক্রমে অপারেশন চালাইবার জন্য আদেশ দেন। উক্ত আদেশ আবু তাহের সাহেব দিয়াছেন। অতঃপর তাহাদিগকে ১৫টি গ্রেনেড বুঝাইয়া দেয়া হয়। জোহরের নামাজের আগে সকলেই কাজলের বাসায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এবং দ্রুত নামাজ আদায় করে। তাহার পরপরই সকলেই জনসভার উদ্দেশে রওনা হয়। ঘটনার পর আহসান উল্লাহ কাজল মোবাইলে আমাকে ফোন করে এবং বলে যে, কাজ হইয়াছে। কাজ শেষে যে যার গন্তব্যে চলিয়া গিয়াছে। উক্ত গ্রেনেড হামলার দুই-তিন দিন পর বাদ জোহর মাওলানা আবু সাইদ মধ্য বাড্ডার সেফতানুল উলুম মাদ্রায় আসেন। উক্ত সংবাদ পাইয়া আমি মাদ্রাসায় যাই। পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, ঘটনা কিভাবে এলোমেলো হইয়াছে। আমি তখন বলিয়াছি যে, আমাকে কেন এই ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করেন। উক্ত আবু তাহের, আবু জান্দাল, আহসান উল্লাহ কাজল তাহা জানে। উপরোক্ত গ্রেনেড হামলার ঘটনার বিষয়ে মূল পরিকল্পনাকারী মাওলানা আবু তাহের ও আব্দুস সালাম পিন্টু এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাকে জড়িত করা হইয়াছে এবং তদনুযায়ী সার্বিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করিয়াছি। এই আমার বক্তব্য। পৃথক কাগজে আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর শেষ বাক্যে বলেন যে, উপরোক্ত গ্রেনেড হামলার বিষয়ে মূল পরিকল্পনাকারী আবু তাহের ও আব্দুস সালাম পিন্টু এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাকে জড়িত করা হইছে এবং তদনুযায়ী আমি সার্বিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করিয়াছি। দ্বিতীয় জবানবন্দী ॥ ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল রেকর্ডকারী ম্যাজিস্টেট এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া, এসিএমএম, ঢাকার নিকট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মতে আসামি প্রদত্ত দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করেন। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, আমি হাফেজ মাওলানা মুফতি আব্দুল হান্নান এই মামলায় পূর্বে একবার স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছিলাম। তখন আমি সব কথা বলতে পারি নাই। মাননীয় মহানগর দায়রা জজ আদালতে স্বেচ্ছায় একটি দরখাস্ত দিয়া আরও কিছু কথা বলার ও লেখার আছে জানালে তিনি আমার দরখাস্ত মঞ্জুর করেছেন। আজকে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন ওই বিষয়ে আমার বক্তব্য আপনার দ্বারা রেকর্ড করতে। আমি বিবেকের তাড়নায় পূর্বের প্রদত্ত দোষ স্বীকারোক্তির সময়ের সঙ্গে আজকের বক্তব্য পেশ করিতেছি। আমি যেভাবে বলব হুবহু সেভাবে লেখার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করিতেছি। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকার গঠন করে। তখন বিএনপির সঙ্গে আমাদের সংগঠনের সম্পর্ক আরও জোরদার করার লক্ষ্যে হরকত-উল জিহাদের আমির মাওলানা আব্দুস সালাম, শেখ ফরিদ, মাওলানা ইয়াহিয়া, আবুবক্কর, জাহাঙ্গীর বদর একত্রে চট্টগ্রামের এমপি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও কুমিল্লার মুরাদনগরের এমপি কায়কোবাদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা আমাদের আমির মাওলানা আঃ সালামসহ তাদের সাথে দেখাসাক্ষাত করে। ১৯৯৬ সালে যে ৪১ জন বাঁশখালীতে গ্রেফতার ছিল তাদের হাইকোর্ট থেকে জামিনের ব্যবস্থা করে দেয়। এভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে এবং তাদের সহায়তাও দিয়ে আসতে থাকে। ২০০৩ সালের শেষের দিকে আমাদের আমির মাওলানা আব্দুস সালাম, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাজউদ্দিন এদের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সাথে যোগাযোগ হয়। যোগাযোগের মাধ্যমে বাবর সাহেবের বেইলী রোডের সরকারী বাসায় যায়। সেখানে জি কে গউস, আরিফুল ইসলাম আরিফ (কমিশনার, সিলেট), ইয়াহিয়া (মাওলানা), আবু বক্কর ওরফে আব্দুল করিম (মৌলভীবাজার, বড়লেখা) উপস্থিত ছিল। এ সময় আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেখানে আমির সাহেবের সাথে কথা বলে এবং জি কে গউস এবং আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফকে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (এখন) এদের সিলেটের কাজের ব্যাপারে বলে এবং স্থানীয়ভাবে কাজের জন্য হুকুম দেয়। সেখানে স্থানীয় বিএনপি ও হরকত-উলের লোক দ্বারা বিভিন্ন জায়গায় গ্রেনেডের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে ২০০৪ সালের প্রথমদিকে হরকত-উল জিহাদের একটা মিটিং হয়, যেখানে উপস্থিত ছিল আমাদের আমির মাওলানা আব্দুস সালাম, মাওলানা শেখ ফরিদ, হাফেজ জাহাঙ্গীর বদর (জান্দাল)। ওই মিটিং হয় দারুল আরকান মাদ্রাসা (হরকত-উলের অফিস), মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের (দোতলায়) ওই মিটিংয়ে তাজউদ্দীন, আবু বক্কর, ইয়াহিয়াও উপস্থিত ছিল। এরা মিটিং করে কিভাবে তারেক জিয়া, বাবরের সঙ্গে কথা বলা যায়। আমরা পরে মোহাম্মদপুর সাত মসজিদে মাওলানা আব্দুস সালাম, মাওলানা আব্দুর রউফ, মাওলানা তাজউদ্দীন, কাশ্মীরী নাগরিক আব্দুল মাজেদ ভাটসহ একত্রে পরামর্শ করে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যার পরিকল্পনা করি। মাওলানা তাজউদ্দীন গ্রেনেড সরবরাহ করার দায়িত্ব নেয়, তার ভাই উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু ও প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর আমাদের সাহায্য করবে মর্মে জানায় এবং তারেক জিয়ার সাথে যোগাযোগেরও সিদ্ধান্ত হয়। এরপর একদিন তারিখ ও সময় মনে পড়ছে না, মুরাদনগরের এমপি কায়কোবাদ সাহেব আমাদের হাওয়া ভবনে নিয়ে গিয়ে তারেক জিয়া ও হারিছ চৌধুরী সাহেবদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। আমরা আমাদের কাজকর্মের জন্য তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা চাইলে তারেক জিয়া আমাদের সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ^াস দেয়। এরপর আমরা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যার জন্য মোহাম্মদপুরসহ আরও কয়েক জায়গায় গোপন মিটিং করি। ২০০৪ সালের আগস্ট মাসে (তারিখ স্মরণ নাই) সিলেটে গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে ঢাকার মুক্তাঙ্গনে আওয়ামী লীগের প্রতিবাদ সভার সংবাদ জানতে পারি। সেখানে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেই। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পুনরায় তারেক জিয়ার সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত হয়। আমি, মাওলানা আবু তাহের, শেখ ফরিদ, মাওলানা তাজউদ্দীন, আল মারকাজুলের গাড়িতে করে মাওলানা রশিদসহ হাওয়া ভবনে যাই। সেখানে হারিছ চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর মুজাহিদ, বিগ্রেডিয়ার রেজ্জাকুল হায়দার, বিগ্রেডিয়ার আব্দুর রহিমকেও উপস্থিত পাইছি। কিছুক্ষণ পর তারেক জিয়া আসেন। আমরা তাদের কাছে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর হামলা করার পরিকল্পনার কথা জানাইয়া তাদের সহায়তা চাই। তখন আমাদের সকল প্রকার প্রশাসনিক সহায়তার আশ^াস দিয়ে তারেক সাহেব বলেন যে, আপনাদের এখানে আর আসার দরকার নাই। আপনারা বাবর সাহেব ও আব্দুস সালাম পিন্টুর সাথে যোগাযোগ করে কাজ করবেন, তারা আপনাদের সকল প্রকার সহায়তা করবে। ১৮ আগস্ট আমি, আহসান উল্লাহ কাজল, মাওলানা আবু তাহের, আব্দুস সালাম পিন্টুর ধানম-ির সরকারী বাসায় যাই। সেখানে আব্দুস সালাম পিন্টু, বাবর, মাওলানা তাজউদ্দীন, কমিশনার আরিফ ও হানিফ পরিবহনের হানিফ উপস্থিত ছিল। আব্দুস সালাম পিন্টু ও লুৎফুজ্জামান বাবর বলে যে, কমিশনার আরিফ ও হানিফ সাহেব আপনাদের সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করবে এবং আপনাদের সকল প্রকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকবে। সে মোতাবেক ২০ আগস্ট মুফতি মঈন ওরফে আবু জান্দাল ও আহসান উল্লাহ কাজল আব্দুস সালাম পিন্টুর বাসা থেকে ১৫টি গ্রেনেড, ২০ হাজার টাকা গ্রহণ করে বাড্ডার বাসায় নিয়ে আসে। ২১ তারিখে আগস্ট মাস, ২০০৪ ইং আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গ্রেনেড হামলা চালাই। ২১ আগস্ট, ২০০৪ তারিখে আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে আমার পূর্বে দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়াছি। অবশিষ্ট তথ্য দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে দিলাম।
×