ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

লেবানন সঙ্কট ॥ ট্রাম্প জামাতা কুশনার নেপথ্য কুশীলব!

মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের পূর্বাভাস

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ১২ নভেম্বর ২০১৭

মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধের পূর্বাভাস

লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি গত সপ্তাহে যখন মিত্র দেশ সৌদি আরব সফর করেন তখন এটিকে প্রথমে শুভেচ্ছা সফর হিসেবে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরদিনই হারিরি অপ্রত্যাশিতভাবে সৌদি রাজধানী রিয়াদ থেকে এক ভিডিওচিত্রে স্বদেশে তার জীবননাশের আশঙ্কায় পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। এর থেকে তিনি সৌদি আরবেই আছেন এবং লেবাননে আর ফিরে যাননি। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাদ হারিরির এই আকস্মিক পদত্যাগ ঘরে-বাইরে নানা ধরনের জল্পনা-কল্পনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, এটি তার পদত্যাগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং এটি মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি রাজনৈতিক সঙ্কট বা বিপর্যয়ের সূচনা করল। এর আগে সৌদি আরব ইয়েমেনের স্বেচ্ছা নির্বাসিত প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহকে আশ্রয় দিয়ে সে দেশের ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে। উপসাগরীয় মিত্রদের নিয়ে গঠিত সৌদি জোট সেখানে নির্বিচারে বোমা হামলা ও বিমান আক্রমণ চালিয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের কারণ ঘটিয়েছে। এখন ইয়েমেনের বিদ্রোহীকবলিত এলাকায় দুর্ভিক্ষ ও কলেরা মহামারী আকার ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় সাদ হারিরিকে আশ্রয় দিয়ে সৌদি আরব কি যুদ্ধের আরেক ফ্রন্ট বা রণাঙ্গন খুলতে যাচ্ছে? সাদ হারিরি লেবাননের এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। তার পিতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে ২০০৫ সালে অতর্কিত হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। সাদ হারিরি তার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, তিনি ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহ গ্রুপের দ্বারা তার জীবননাশের আশঙ্কা থেকে এই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা হলো, তার এই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত তার অতিঘনিষ্ঠ আত্মীয় বা সহকারী কেউ আগে থেকে জানতে পারেনি, যা সবাইকে হতবাক করেছে। তাই লেবাননের জোট সরকারের অন্যতম শরিক দল হিজবুল্লাহ গ্রুপ এই মর্মে অভিযোগ করেছে যে, সৌদি সরকার সাদ হারিরিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রেখে বলপূর্বক পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছে। জবাবে সৌদি প্রশাসন জানিয়েছে, তারা গুপ্তহত্যা থেকে বাঁচাতে হারিরিকে আশ্রয় দিয়েছে। সেই সঙ্গে দেশটি তার নাগরিকদের লেবানন ত্যাগের নির্দেশ দেয়। অনেকের মতে সৌদি আরবের চির বৈরী দেশ ইরানের মিত্র ইয়েমেনী হুতিদের বিরুদ্ধে সৌদিরা যেরূপ অভিযান চালাচ্ছে, তারা একই কায়দায় উত্তর সীমান্তে লেবাননেও যুদ্ধ তৎপরতার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। কারণ লেবাননের হিজবুল্লাহ গ্রুপ ইরানের সমর্থনপুষ্ট হয়ে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে ও আইএস জঙ্গীদের বিরুদ্ধে এতদিন ধরে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে। আইএস জঙ্গীদের বিরুদ্ধে এতদিনকার যুদ্ধে হিজবুল্লাহর অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি অনেকটাই কমে এসেছে এবং এ বিষয়টি সামনে রেখে ইসরাইলকে সঙ্গে নিয়ে যদি হিজবুল্লাহকে মোকাবেলা করা যায় তবে এই এলাকায় ইরানের প্রভাব ক্ষুণœ হবে। এ ধরনের একটি হিসাব-নিকাশ করার জন্য সাদ হারিরি সৌদি আরব পৌঁছার সপ্তাহখানেক আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও জামাতা জারেড কুশনার এক গোপন মিশনে ইসরাইল ও সৌদি আরব সফর করেন। কুশনার সৌদি আরবের নতুন যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বেশ কয়েক ঘণ্টা যাবত শলাপরামর্শ করেন, যার বিষয়বস্তু সম্পর্কে হোয়াইট হাউস কোন মন্তব্য করেনি। তবে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিতে ইরানের অব্যাহত প্রভাবে সৌদি আরব ও ইসরাইল সমভাবে শঙ্কিত। তাই ইরানকে কোণঠাসা করার জন্য সুন্নী মুসলিমদের নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র সৌদি আরব যদি চিরশত্রু ইহুদী রাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মেলায় তবে খুব একটা অবাক হওয়ার মতো বিষয় হবে না। একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে, ২০০৬ সালে লেবাননী হিজবুল্লাহদের সঙ্গে যুদ্ধে ইসরাইল সুবিধা করতে পারেনি বরং হিজবুল্লাহ অনেক স্থানে তাদের প্রতিহত করেছে। গত শুক্রবার হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নসরুল্লাহ বলেছেন, কোন অনুমান বা বিশ্লেষণ নয়, আমি সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলছি যে, সৌদিরা ইসরাইলকে লেবাননে হামলা চালাতে বলেছে। তার কথার সপক্ষে হিজবুল্লাহ নেতা কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ না দিতে পারলেও পাশ্চাত্য ও স্থানীয় রাজনীতি বিশ্লেষকরা হাসান নসরুল্লাহর কথায় যুক্তি আছে বলে মেনে নিয়েছেন। অপরদিকে ইসরাইলী কর্মকর্তারা হিজবুল্লাহর সঙ্গে আরেকটি যুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে না দিলেও তারা এ ধরনের যুদ্ধ পরিহারের জন্য সব ধরনের চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী নিয়ে সদা আতঙ্কগ্রস্ত ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর আশঙ্কা যে, হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের এখনই থামানো না গেলে তারা তাদের সঙ্গে থাকা ভারি অস্ত্রশস্ত্র সিরিয়া রণাঙ্গন থেকে লেবাননে নিয়ে আসবে, যা শেষ পর্যন্ত ব্যবহৃত হবে ইসরাইলের বিরুদ্ধে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জেরুজালেমভিত্তিক বিশ্লেষক ওফার জালজবার্গ বলেছেন, এই অঞ্চলের অনেকেই চায় যে, সৌদি আরবের পক্ষ নিয়ে ইসরাইল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাতে কারও ফায়দা হবে না। ভেতরে ভেতরে যাই ঘটুক, প্রকাশ্যে ইসরাইলের পক্ষ থেকে কোন যুদ্ধ প্রস্তুতি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। দেশটি তার সৈন্যদের উত্তরাঞ্চলে লেবানন সীমান্তসংলগ্ন এলাকার দিকে পাঠায়নি বা রিজার্ভ সৈন্যদেরও তলব করেনি। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে, ইসরাইলী সমর বিশারদরা এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, হিজবুল্লাহর সঙ্গে পরবর্তী যুদ্ধ খুবই বিপর্যয়কর হতে পারে এবং তা শুরু হলে কয়েকদিনের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যাবে। কারণ, হিজবুল্লাহর হাতে এখন এক লাখ ২০ হাজার রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যা ইসরাইলী ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দিতে পারে। নিউইয়র্ক টাইমস
×