ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মূল টার্গেট অছাত্র পাঠানো

প্রলোভনে ফেলে সাইপ্রাসে ছাত্র পাঠাচ্ছে এক শ্রেণীর দালাল

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ৫ নভেম্বর ২০১৭

প্রলোভনে ফেলে সাইপ্রাসে ছাত্র পাঠাচ্ছে এক শ্রেণীর দালাল

ফিরোজ মান্না ॥ উচ্চশিক্ষার আড়ালে সাইপ্রাসে কর্মী পাঠাচ্ছে একশ্রেণীর প্রতিষ্ঠান। এই কর্মীদের লোভ দেখানো হচ্ছে, সাইপ্রাস যেতে পারলেই ইউরোপ আমেরিকায় যাওয়া নিশ্চিত। ইউরোপ আমেরিকার স্বপ্নের টানে দেশ থেকে এ পর্যন্ত ৫শ’র বেশি ছাত্র-অছাত্র দেশটিতে চলে গেছেন। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠানের সরকারী কোন অনুমতি নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো মিডিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে লোক সংগ্রহ করছে। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনে অনেক ছাত্র আকৃষ্ট হয়ে সাইপ্রাস যাচ্ছেন। তবে মূল ব্যবসা হচ্ছে ছাত্রের আড়ালে অছাত্র পাঠানো। বলা হচ্ছে, এখান থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমানো খুবই সহজ। এসব প্রতিষ্ঠান সাইপ্রাসে ছাত্র-অছাত্র যেই হোক তার কাছ থেকে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা নিচ্ছে। তাদের কোন জবাবদিহিতাও নেই। সাইপ্রাসে বাঙালী একটি দালাল গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। মূলত দেশ থেকে সাইপ্রাসে অবস্থানকারী ওই গ্রুপের মাধ্যমে লোক পাঠানো হয়। বিষয়টি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশটিতে বৈধ কোন জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান লোক পাঠাচ্ছে না। ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড দেখা যায় ‘আপনি কি উচ্চ শিক্ষার জন্য সাইপ্রাস গমন করবেন, তাহলে আজই আমাদের সঙ্গে যোগোযোগ করুন’। সাইনবোর্ডের কয়েকটি মোবাইল নাম্বারও দেয়া থাকে। বিষয়টি আমাদের চোখেও পড়েছে। এটা যে প্রতারণা তা স্পষ্ট। কিন্তু এই প্রতারণার বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করার নেই। করতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা কিভাবে সাইপ্রাসে ছাত্রের আড়ালে অছাত্র পাঠাচ্ছে তা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা না নিলে বহু পরিবার পথে বসবে। এমনিতেই জনশক্তি রফতানি খাতে প্রতারণার ব্যাপকতা চরম আকার ধারণ করেছে। দালাল চক্রের এটি একটি নতুন ফন্দি। এতদিন লিবিয়া ও ইরাকের রুট ব্যবহার করে লোকজনকে ইউরোপ-আমেরিকার লোভ হাজার হাজার মানুষকে লিবিয়ায় আটক হতে হয়েছে। আবার যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছিলেন, তাদের অনেককেই সলিল সমাধি বরণ করতে হয়েছে। ঠিক এমন একটি পথ সাইপ্রাস। দেশটিতে যেতে পারলেই ইউরোপ-আমেরিকায় ঢোকা নিশ্চিত এমন গ্যারান্টি দিচ্ছে দালাল চক্র। দালাল চক্র ছাত্রদের লোভ দেখায়, সাইপ্রাসে পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সপ্তাহে ২০ থেকে ২৫ ঘণ্টা কাজের সুযোগ পাবেন। প্রতিঘণ্টা কাজের জন্য ১০ ইউরো করে দেয়া হয়। তাতে সারা মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা ছাত্ররাই আয় করতে পারবে। এই টাকায় তাদের লেখাপড়া, খাওয়া চলে যাবে। কিছু টাকা দেশেও পাঠাতে পারবে আর ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ তো রয়েই গেছে। শুধু ইউরোপ কেন, যে কোন দেশে যাওয়ার সুযোগ থাকবে তাদের। ছাত্র পরামর্শকসহ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমন সব প্রলোভন দেখিয়ে ছাত্র পাঠাচ্ছে সাইপ্রাসে। দালালরা দেশটিকে ধনী দেশ হিসেবে প্রচার করলেও বাস্তবে এটি একটি দ্বীপরাষ্ট্র। ইউরোপের ক্ষুদ্র দেশগুলোর মধ্যে একটি। এখানে তেমন কোন কাজের সুযোগ নেই। এমনকি উচ্চশিক্ষার জন্যও এই দেশটিতে তেমন কোন সুযোগ-সুবিধা নেই। তাহলে দালালরা কেন এই দেশটি বেছে নিল এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বজুড়েই শ্রমের বাজার মন্দা। দালালরা আদম পাচার করে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য সাইপ্রাসকে ব্যবহার করছে। এখান থেকে ইউরোপ-আমেরিকায় যাওয়া সহজ বলে প্রচার করছে। আমাদের দেশের বেকার তরুণরা দালালদের পাতা ফাঁদে সহজেই পা দিচ্ছে। ইউরোপজুড়ে মন্দার প্রভাব সেখানেও পড়েছে। তাই সাইপ্রাসে থাকা বাংলাদেশী ছাত্ররা এখন চরম অর্থকষ্টে পড়েছে। বাধ্য হয়ে কাজের দাবিতে তারা আন্দোলনও করেছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। সম্প্রতি সাইপ্রাস থেকে বাংলাদেশের এক ছাত্র টেলিফোনে জানান, নিয়মানুযায়ী আন্তর্জাতিক ছাত্ররা সে দেশে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ করতে পারে। ওই নিয়মে কাজ করার জন্য প্রত্যেককে সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু দেশটিতে কোন বিদেশী ছাত্রকে কাজ করার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। অনুমতি ছাড়া কেউ কোথাও কাজ করলে তাকে আটক করে জরিমানা করা হয়। এ জন্য বেশিরভাগ বাংলাদেশী ছাত্র চরম বিপাকে পড়েছেন। বাসা ভাড়া, খাওয়া-দাওয়ার খরচ মেটানোই এখন তাদের জন্য চরম কষ্টের বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছে। তুলনামূলকভাবে অসচ্ছল এ বাংলাদেশীরা টিউশন ফিও এখানে কাজ করেই উপার্জন করে থাকে। এ কারণে তাদের জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার পথে। তারা চিন্তা করছে কী করে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপের যে কোন দেশে ঢুকে পড়তে পারে। ইউরোপের এই দেশটির আয়তন মাত্র ৯ হাজার ২৫১ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা মাত্র আট লাখ ৭৯ হাজার। এখানে কাজের কী এমন সুবিধা থাকতে পারে। আমাদের যখন বাংলাদেশ থেকে সাইপ্রাস পাঠানো হয়, তখন বলা হয়েছিল সাইপ্রাস অনেক ধনী দেশ। সেখানে এক ঘণ্টা কাজ করলে ১০ ইউরো পাওয়া যায়। প্রথম দিকে আমরা যখন কাজ করতাম তখন আমাদের ঘণ্টায় ৪ থেকে ৫ ইউরো দেয়া হতো। এখন তো কাজ করার অনুমতিই দিচ্ছে না। সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তাদের নিযুক্ত দালালরা নানা প্রলোভন দেখিয়ে সাইপ্রাস যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে। ওই প্রলোভনে পড়ে অনেক ছাত্র-অছাত্র দেশটিতে এসেছে।
×