ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

চার পুরনো বিদ্যুত কেন্দ্র চালু রেখে শত শত কোটি টাকা লোকসান

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

চার পুরনো বিদ্যুত কেন্দ্র চালু রেখে শত শত কোটি টাকা লোকসান

রশিদ মামুন ॥ বছরের পর বছর ধরে বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) অতিরিক্ত দরে চারটি পুরনো কেন্দ্র দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখায় সরকারের শত শত কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে। বিদ্যুত বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে এলেও ১১৬ মেগাওয়াটের চার কেন্দ্র বন্ধ করছে না পিডিবি। গত অর্থবছরেই বিদ্যুত কেন্দ্র চারটি প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদনে ব্যয় করেছে ৩৭ টাকা ৪৮ পয়সা, যা নতুন বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয়ের দ্বিগুণ। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর কারণে গত অর্থবছরেই ৩০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। সরকারের দাবি অনুযায়ী বিদ্যুত কেন্দ্রের স্থাপিত ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট অতিক্রম করেছে। সেখানে কেন অতিরিক্ত দরের এ বিদ্যুত কেন্দ্রের প্রতি পিডিবির এত মায়া তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বলা হচ্ছে, চারটি বিদ্যুত কেন্দ্রই নির্মাণ করা হয়েছে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে। বিগত দশকেই বিদ্যুত কেন্দ্র চারটির অর্থনৈতিক জীবন শেষ হয়েছে। কিন্তু এখনও বিদ্যুত কেন্দ্র চারটি চালু রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বিদ্যুত কেন্দ্র চারটি বন্ধ করার জন্য সুপারিশ করেছে। বিদ্যুত কেন্দ্র চারটি হলোÑ ভেড়ামারা ৬০ মেগাওয়াট, সৈয়দপুর ২০ মেগাওয়াট, রংপুর ২০ মেগাওয়াট এবং বরিশাল ৪০ মেগাওয়াট। কেন্দ্র চারটি গত অর্থবছরে ১৬৫ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন করেছে। আর এতে পিডিবি ৬১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বিদ্যুত কিনেছে। কিন্তু একই জ্বালানি অর্থাৎ ডিজেলেই নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে সমপরিমাণ বিদ্যুত ৩২১ কোটি টাকায় পাওয়া যেত। এতে চার বিদ্যুত কেন্দ্রে নিট গচ্চার পরিমাণ ২৯৭ কোটি টাকা বলে মনে করা হচ্ছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুরাতন বিদ্যুত কেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় অত্যধিক। একটি মহলের বড় ধরনের ব্যবসার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে পুরাতন বিদ্যুত কেন্দ্র। নানা অজুহাতে দরপত্র ছাড়াই যন্ত্রাংশ কেনা হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও কিনে রাখা হয়। আবার যেহেতু কেন্দ্রগুলো ডিজেলচালিত তাই এখানে তেলের একটি বাণিজ্য রয়েছে। তবে এসব কাজ সুকৌশলে করায় একটি মহল লাভবান হলেও লোকসান গুনতে হয় সরকারকে। বিদ্যুতের দর বৃদ্ধির মাধ্যমে যার বোঝা সবাই মিলে বহন করে। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও গত বছর কেন্দ্রগুলো বন্ধের বিষয়ে পিডিবিকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। এর বাইরে অর্থ মন্ত্রণালয় গত অর্থবছরের বাজেটের সময় কেন্দ্রগুলোর অতিরিক্ত দরে বিদ্যুত উৎপাদনের কথা উল্লেখ করে বন্ধের সুপারিশ করে। চার কেন্দ্রের মধ্যে ভেড়ামারা ৬০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি ১৯৮০ সালে উৎপাদন শুরু করে। কেন্দ্রটির অর্থনৈতিক জীবনকাল ২০ বছর ধরে হিসাব করলে ২০০০ সালে বিদ্যুত কেন্দ্রটির অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু অর্থনৈতিক জীবনকাল শেষের ১৭ বছর পরও কেন্দ্রটি চলছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটির ৬০ মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা কমে ৪৬ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রটি গত অর্থবছরে ৫৮ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন করেছে। এতে পিডিবির ব্যয় হয়েছে ২০৯ কোটি টাকা। সৈয়দপুর ২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি ১৯৮৭ সালে উৎপাদন শুরু করে। হিসাব অনুযায়ী কেন্দ্রটি ২০০৭ সালে অবসরে যাওয়ার কথা। কিন্তু অবসরে যাওয়ার সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার ১০ বছর পর পর্যন্ত কেন্দ্রটি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গত অর্থবছরে এ কেন্দ্র থেকে ৩৩ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুত কিনেছে পিডিবি। এতে ব্যয় হয়েছে ১২১ কোটি টাকা। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে চালু হয় রংপুর ২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি। জীবনকাল শেষের পরও ৯ বছর পর্যন্ত কেন্দ্রটি চলছে। গত অর্থবছরে কেন্দ্রটির ২৭ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুত ক্রয়ে ১১৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। একই ভাবে বরিশাল ৪০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি ১৯৮৭ সালে উৎপাদনে আসে। এ কেন্দ্রের জীবনকালও আরও ৯ বছর আগে শেষ হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রটি এখনও চালু রাখা হয়েছে। কেন্দ্রটি গত অর্থবছরে ৪৭ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন করেছে। পিডিবি ১৭০ কোটি টাকায় ওই বিদ্যুত কিনেছে। জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, যে যুক্তিতে এ কেন্দ্রগুলো চালু রাখা হচ্ছে তা পুরোপুরি অযৌক্তিক। তিনি বলেন, আমরা বছরে ৫ হাজার ৫০০ কোটি ইউনিট বিদ্যুত ব্যবহার করছি। এর মধ্যে তারা সামান্য পরিমাণ বিদ্যুত দিয়ে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত দরে তা আমাদের কিনতে হয়। পিডিবি এসব ক্ষেত্রে উদাসীন হওয়ায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় না। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন তার সুপারিশে বলছে, এ কেন্দ্রগুলোর অর্থনৈতিক জীবনকাল অনেক আগেই শেষ হওয়ায় কেন্দ্রগুলো অবসরে পাঠাতে হবে। তারা বলছে, ইতোমধ্যে ১০ হাজার মেগাওয়াট নতুন দক্ষ বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখন এ ধরনের পুরাতন কেন্দ্রের আর দরকার নেই। দেখা গেছে, ডিজেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদনে গড়ে ১৩ থেকে ১৪ টাকার জ্বালানি ব্যয় করে থাকে। এর বাইরে আরও ৬ টাকার মতো জ্বালানি ব্যয় হয়ে থাকে। এতে নতুন ডিজেলচালিত কেন্দ্র এক ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদনে ১৯ থেকে ২০ টাকা ব্যয় করে থাকে। সে হিসাবে ৩৭ টাকা ৪৮ পয়সায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়। পিডিবির তরফ থেকে উৎপাদন কম থাকার অজুহাত দাঁড় করানো হলেও দেখা যায় নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র পুরোদমে না চালিয়ে পুরাতন কেন্দ্র থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে। জানতে চাইলে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, আমরা পিডিবিকে বলেছি, অনেক হয়েছে এখন এসব বন্ধ করতে হবে। ইতোমধ্যে নতুন অনেক কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এখন আর এত পুরাতন কেন্দ্রের দরকার নেই। পিডিবি এর পরও উত্তরাঞ্চলে লো ভোল্টেজ সমস্যার কথা বলায় আমরা বলেছি ভোল্টেজ ঠিক রাখার বিকল্প ব্যবস্থা থাকায় এটি কোন অজুহাত হতে পারে না। তিনি জানান, এখনও বিদ্যুতের দামের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি। কমিশনের আদেশে ই চারটি কেন্দ্র বন্ধের বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে বলে জানান তিনি।
×