ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

অপূর্ব কুমার কুণ্ডু

আরণ্যকের অর্জন পুষ্পমঙ্গলে উদযাপন

প্রকাশিত: ০৬:৫৬, ২৬ অক্টোবর ২০১৭

আরণ্যকের অর্জন পুষ্পমঙ্গলে উদযাপন

কবির কথায়, সংসারের বিষবৃক্ষে দুটি ফল মধুময়/কাব্যামৃত স্বাদ আর সজ্জনের পরিচয়। কিন্তু প্রবাদ-প্রবচন আর প্রাত্যহিক কথায়, বৃক্ষ তোমার নাম কি ফলে পরিচয়। পরিচয় প্রশ্নে শিল্প যেহেতু পেটের ক্ষুধা নিবৃত্তি অপেক্ষা হৃদয়ের পিপাসা নিবৃত্তিতে বেশি নিমগ্ন, প্রয়োজন অপেক্ষা অপ্রয়োজনীয় রসাস্বাদন তার অভীষ্ট ফলে সেখানে শিল্প বৃক্ষের পরিচয় ফল অপেক্ষা ফুলে, খাবার অপেক্ষা সৌরভে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অপেক্ষা ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে, ভোগ্য অপেক্ষা উপভোগে, ক্ষয় অপেক্ষা অক্ষয়ে, কুক্ষিগত অপেক্ষা বিতরণে। অরণ্যে কিংবা জনারণ্যে ফোটা ফুল জাতিতে এক হলেও বিকাশ এবং প্রকাশে তা ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির, অভীষ্ট ভিন্ন রুচির অনুরাগীর। শরতের ফোটা শিউলি যেখানে উৎসবের আবহন, সূর্যমুখী সেখানে খরার বিপরীতে প্রতি স্পর্ধার উচ্চারণ আবার রক্তকরবী সেখানে প্রতিকূলতাকে জয় করে অস্তিত্বের কালজয়ী শিহরণ। শিহরিত উচ্ছ্বাসিত এবং বেগবান নাট্যদল আরণ্যক তার নাট্যযাত্রার চলতি পঁয়তাল্লিশ বছরের পদার্পণে। আরণ্যকের অরণ্যে তাই মানব মঙ্গলে উদ্ভাসিত ফুটন্ত ফুলের সমাহার। কোন ফুল সৌরভ ফুল ছড়িয়ে ঝরে গেছে পথের ধুলায়, কোন জায়গা ছেড়ে দিয়েছে নতুন কুঁড়ির আগমনী বার্তায়। স্বাধীন বাংলাদেশে কবর নাটক দিয়ে যার সৌরভের প্রথম বন্ধনা, ওরা কদম আলী’তে এসে বিদ্রোহের দানা বাঁধা, মুক্ত নাটকের চর্চা যাদের সার্বজনীনতা, পথ নাটকে এসে তারাই মিছিল-বিক্ষোভের সমান্তরাল স্বৈরাচারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঢেউ তোলা। নানাকার পালায় তারা যেমন শ্রমজীবী কৃষকদের বঞ্চনার প্রতিভূ, কোরিওলেনাসে এসে বিশ্ব নাটকের গর্বিত অংশীদার, জয়জয়ন্তীতে এসে বিপ্লবী তো ময়ূর সিংহাসনে এসে শিল্প জীবনের ব্যথাতুর রক্তক্ষরণ, সংক্রান্তিতে এসে সং তো এবং বিদ্যাসাগরে এসে জীবনের জয়গান। শত্রুগণে এসে কর্পোরেট ফাঁদের দাবানলতো স্বপ্ন পথিকে এসে পোশাক কর্মীদের বঞ্চনার কার্যকারণের অনুসন্ধান, রাঢ়াঙ নাটকে সাঁওতালীদের ভূমি আঁকড়ে থাকার লড়াই তো ভঙ্গবঙ্গ নাটকে এসে দেশভাগের যন্ত্রণা। জুবলী হোটেলে এসে সাম্প্রতিক বহুমুখী অস্থিরতা কিন্তু অরণ্য থেকে জাত আরণ্যক নাট্যদলের নাট্যারণ্যে প্রস্ফুটিত পুষ্পে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের মূল্যায়ন, আরণ্যক বরাবরের মতোই ঘ্রাণে-রূপে-সৌন্দর্যে মানব মঙ্গলে সম্পৃক্ত সমাজ সচেতন নাট্যদল। ফলে সচেতনভাবেই এবং পথ পরিভ্রমণের পঁয়তাল্লিশ বছরের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায়, নাট্যশালার লবি এক্সপেরিমেন্টাল হল, সেমিনার হল, মহড়াকক্ষ, নন্দনমঞ্চ জুড়ে গত ২২ থেকে আগামী ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মোট ৭ দিনব্যাপী আরণ্যক এর ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে উদযাপিত নাট্যোৎসবের শিরোনাম ‘পুষ্প ও মঙ্গল আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব ২০১৭।’ বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নরওয়ে, হংকং মোট পাঁচ দেশের নাটকের মঞ্চায়ন, প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, ২৫ ও ২৬ তারিখে নৃত্য ও অভিনয়ের প্রশিক্ষণ কর্মশালা, আগামীকালের আড্ডাও পদক প্রদান, প্রথম দিনের উদ্বোধন, আগামী পরশুর সমাপনীর মধ্যে দিয়ে আরণ্যক এর উৎসব উদযাপন। আরণ্যকের প্রথম নাটকের রচয়িতা মুনীর চৌধুরীর স্ত্রী এবং কঠিন সময়ে সম্ভ্রান্ত পরিবার থেকে এতে প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে অভিনয় করা অভিনেত্রী লিলি চৌধুরীর হাত দিয়ে উৎসব উদ্বোধন এবং প্রথম দিনের ইবলিশ নাটক মঞ্চায়ন শেষে যাত্রা স¤্রাজ্ঞী জ্যোৎ¯œা বিশ্বাসের হাত দিয়ে ক্রেস্ট প্রদান ভাবতে শেখায়, ভুলভুলাইয়ার এই দোদুল্যমান সময়ে একজন মামুনুর রশীদের বড্ড বেশি প্রয়োজন নইলে হারিয়ে যাওয়া মানুষকে খুঁজে সামনে আনার কেউ রইল না। না না করেও উৎসবে পথনাটক চারটি কিন্তু মঞ্চনাটক তার থেকেও বেশি অর্থাৎ সাতদিনের উৎসবে মঞ্চনাটক দশটি। প্রথমদিন শোষক ও শোষিতের লড়াইকে উপজীব্য করে আরণ্যকের নাটক ইবলিশ। দ্বিতীয় দিন, সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির ভরকেন্দ্রে ফাটলের নাটক ভারতের আঁধারে সূর্য। একই দিন ধূপপুড়ে ঘ্রাণ ছড়াবার মতো করে অভিনেতা-অভিনেত্রী-কুশীলবদের ক্ষয়ে ক্ষয়ে মানবতার ফুল ফোটাবার নাটক আরণ্যকের ময়ূর সিংহাসন। তৃতীয় দিন, ত্রিপুরার লোকগাঁথা অবলম্বনে পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা আর প্রাণে পাথরের মতো নির্মমতার নাটক রাইমা সাইমা। একই দিন আরণ্যকের মহাকাব্যিক প্রযোজনা রাঢ়াঙ। চতুর্থ দিন, বহিরঙের কারণে এক বঞ্চিতা নারী যে আত্মবিশ্বাসের জোরে মিশে যায় জীবনের মূল ¯্রােতে সে বিষয়ে ভারতের নাটক বৃষ্টি বৃষ্টি। আজ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সর্বস্ব হারিয়ে এক উদ্বাস্তু নারী নরওয়েতে আশ্রয় পেয়ে কিভাবে হয়ে ওঠে নরওয়েজিয়ান তা নিয়ে নরওয়ের নাটক হেরিটেজ। আগামীকাল, অস্ট্রেলিয়া মানচ দ্বীপে পথ হারিয়ে ফেলা নয়জন ইরানী মানুষের বাঁচার লড়াইয়ের ইরানের নাটক মঞ্চ। একই সময় অন্তিম মুহূর্তে দুটি মানবের আত্ম বিশ্লেষণের ভারতীয় নাটক অনুসোচনা। শনিবার সমাপনী দিনে রয়েছে, একক অভিনয়ের বরপুত্র গৌতম হালদার অভিনীত নাটক সখারাম। আধুনিক বিশ্বে লিভ টুগেদারের চর্চা নাকি গৌরবময় ঐতিহ্য আশ্রয়ী সংসার জীবন কোনটি বেশি আদৃত তা নিয়েই রসে বশে টইটুম্বুর উৎসব সমাপনী মঞ্চায়ন সখারাম। সখা আরণ্যকে অনেক কিন্তু পথপ্রদর্শক একজনই তিনি মামুনুর রশীদ। মান্নান হীরা, শাহ আলম দুলাল, ফয়েজ জহির, তমালিকা কর্মকারদের মতো ফুটন্ত গোলাপ নিয়ে তার যে নাট্যারণ্যে বাস সেখানে মানবতা আছে, সমাজের কথা আছে, ইলেকট্রিক মিডিয়ায় দলগত প্রতিষ্ঠা পেয়ে দল ছেড়ে চলে না যাবার সৌন্দর্য আছে, তাৎক্ষণিক অভিনয়ের পাশাপাশি আবহমানকালের টিকে থাকার রচিত নাটক আছে, মঞ্চের আলো আঁধারীতে নিয়মিত উদযাপন আছে। প্রৌরত্বে যৌবন উদযাপনের এই মাহেন্দ্রক্ষণের কলরব আর বিমোহিত ঘ্রাণ কি ভুলে থাকা যায় না আরণ্যক ভুলে থাকতে দেয়! আর এভাবেই আরণ্যক জনারণ্যে মানব মঙ্গল কামনায় একের পর এক পুষ্প শোভিত বাগান সৃজন করেই যায় শিল্প পিপাসুর শিল্প পিপাসা নিবৃত্তির আশায় আশায়।
×