ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

৫ শতাধিক প্রস্তাব এসেছে

নিবন্ধিত ৪০ দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ শেষ

প্রকাশিত: ০৪:৫২, ২১ অক্টোবর ২০১৭

নিবন্ধিত ৪০ দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ শেষ

শাহীন রহমান ॥ শেষ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ। গত ২৪ আগস্ট থেকে শুরু করে বৃহস্প্রতিবার ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত ৪০ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ সম্পন্ন করেছে ইসি। সংলাপে এসব দলের কাছ থেকে প্রায় ৫ শতাধিক প্রস্তাব পেয়েছে নির্বাচন কমিশন। এসব প্রস্তাবের মধ্যে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় যেমন রয়েছে। তেমনি নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতে অভিন্ন প্রস্তাবও রয়েছে। আবার একই বিষয়ে রাজনৈতিক দলোর মধ্যে পরস্পর বিরোধী প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। বৃহস্প্রতিবার জাতীয় পার্টি জেপি এবং এলডিপির সংলাপের মধ্যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ সম্পন্ন করেছে ইসি। ইসির এই সংলাপে নিবন্ধিত দলগুলোর কাছ থেকে ৪৮৬টি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ইসি জানিয়েছে এসব প্রস্তাব একীভুত করে যেগুলোর ইসির এখতিয়ারে রয়েছে সে প্রস্তবের বিষয়ে করনীয় নির্ধারণ করা হবে। অপর দিকে যেসব বিষয়ে ইসির এখতিয়ার নেই সেগুলো প্রয়োজনে সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় এসব প্রস্তাব বিশ্লেষন করে দেখা গেছে প্রবাসীদের ভোটাধিকারের বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলই একমত পোষণ করেছে। এছাড়া নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব রোধ করা, মাস্তানী দলীয় প্রভাবমুক্ত পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবী জানিয়েছেন তারা সবাই। এছাড়া নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কোন ব্যক্তি বা সংস্থার বিরুদ্ধে নির্বাচন নিয়ে কোন পক্ষপাতিত্বে অভিযোগের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতেও ইসির প্রতি তারা অনুরোধ জানিয়েছেন। সব দলের অংশ গ্রহণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি, নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, প্রচারে সরকারি সুবিধা বাদ, কালো টাকা ও পেশীশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন, অনলাইনে মনোনয়ন জমা, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের তৎপরতা বন্ধ, স্বতন্ত্র প্রার্থিতায় ১% সমর্থন তালিকা বাতিল, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনের অধীনস্ত রাখা; যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত ব্যক্তি এবং মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করা, ফৌজদারি দন্ডাদেশ প্রাপ্ত ব্যক্তিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না দেয়া, নির্বাচনে ধমের্র সর্বপ্রকার ব্যবহার, সাম্প্রদায়িক প্রচার প্রচারণা ও ভোট চাওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে নিষিদ্ধ করা, স্বাধীনতা বিরোধী ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলকে নিবন্ধন না দেয়া, প্রার্থীর নাম, দল ও প্রতীকের উল্লেখ সম্বলিত অভিন্ন পোস্টা রের ব্যবস্থা করা, নির্বাচনী বিরোধ তিন মাসের মধ্য নিষ্পত্তি করা, নির্বাচন কালো টাকা ও পেশি শক্তির প্রভাবমুক্ত রাখা, নৈতিক স্খলনের অভিযোগে দন্ডিদের দুই বছর পর সংসদ নির্বাচনে প্রার্থিতার সুযোগ বাতিল করা, যে সব দল ৩০ এর বেশি প্রার্থী মনোনয়ন দেবে সে সব দলকে বে তার ও টিভিসহ সরকারি প্রচারমাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সুযোগ দেয়া, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের কমিশন থেকে প্রত্যাহার করার বিষয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দল একমত পোষণ করেছে। তবে সব রাজনৈতিক দলগুলোর মুল প্রস্তাবগুলো ঘুরে ফিরে নির্বাচনের সময়ের সরকার, সহায়ক স্ররকার বা নির্বাচনের সময়ের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রসঙ্গই বেশি এসেছে। এছাড়া নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙ্গে দেয়া, সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে, বিপেক্ষ এবং ‘হা’ ‘না’ ভোটের পক্ষে এবং বিপক্ষেও জোরালো মতামত এসেছে। এর মধ্যে নির্বাচন সময়ের সরকার ব্যবস্থা এবং সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার বিষয়ে ইসির এখতিয়ারভুক্ত না হলেও অনেক দলের পক্ষ থেকেই ইসির সংলাপে এই বিষয়গুলোই বেশি প্রধান্য দেয়া হয়েছে। যদি? প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা জানিয়ে দিয়েছেন ইসির এখতিয়ারবর্হিভূত বিষয় নিয়ে তাদের করার কিছুই নেই। ইসির আইনের মধ্যে যেসব প্রস্তাব আসবে সেগুলোর বিষয়েই বিবেচনা করা হবে। এদিকে প্রধান রাজনৈতিক দুটি দলের পক্ষ থেকেও মুল কয়েকটি বিষয় নিয়ে পরস্পর বিরোধী প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে। ইসির এখতিয়ারভুক্ত না হলেও বিএনপি সহায়ক সরকার এবং সংসদ ভেঙ্গে নিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। অথচ ইসির এ দুটি বিষয়ে ইসির এখতিয়ারভুক্ত নয়। এছাড়া বিএনপির ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে জোরালো অসবস্থান নিয়েছে তারা। বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগেই সেনাবাহিনী মোতায়েনে এবং আরপিও ধারায় পরিবর্তন করে অন্যান্য আইনশঙ্খলা বাহিনীর স্থলে পতিরক্ষা বাহিনী প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। অপর দিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে সেখানে সহায়ক সরকার বা অন্তবর্তী সরকারের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। তবে ইভিএম ব্যবহার এবং সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে বিপক্ষে মত দিয়েছে তারা। যদিও এদুটি বিষয় ইসির এখতিয়াভুক্ত। গত ১৬ জুলাই ইসির পক্ষ থেকে যে নির্বাচনী রোডম্যাপ দেয়া হয়েছে সেখানে অবশ্য ইভিএম ব্যবহারের কোন কথা বলা হয়নি। যদিও ওই অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন সব রাজনৈতিক দল চাইলে এখনও ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে বলা হয়েছে এই দায়িত্বে অন্যন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ন্যস্ত থাকবে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য নিয়োগ দেয়া যাবে তা ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফোজদারী কার্যবিধির ধারায় সুষ্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই সীমানা পুন:নির্ধারণের বিরোধীতা করা হয়েছে। তবে এই বিরোধীতার ভিন্নতাও রয়েছে। আওয়ামী লীগ চায় ২০১৪ সালের সীমানায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের। অপর দিকে ২০০৮ সালের পুর্বে জাতীয় সংসদের নির্বাচনী আসন সমুহের যে সীমানা ছিল সেই সীমানা পুনর্বহাল করতে। ইসির রোডম্যাপে সীমানা পুণ: নির্ধারণের বিষয়টিও গুরুত্বে সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। জানা গেছে রোডম্যাপ প্রকাশের পর সীমানা নির্ধারণের কাজও শুরু দিয়েছে ইসি। কিন্তু প্রায় সব রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এবং সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও এর বিরোধীতা করা হয়েছে। এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই তৃণমুলের মতামত নেয়ার কথ বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগের এই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে তৃণমুলের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী প্রার্থীদের বাছাই করে সংশ্লিষ্ট রাজনেতিক দলের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে হবে। গত ২০০৮ সালের নির্বাচনে এই বিধান চালু করেছিল তখনকার কমিশন। এবারও ইসির সঙ্গে আলোচনায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেই এই বিধান যোগ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। যা অন্য কোন দলের পক্ষ থেকে করা হয়নি। এ বিষয়গুলো ছাড়াও ৪০ রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে প্রায় অনেক বিষয়েই ঐক্যমত পোষণ করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বলছে অবাধ সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য বিষয়গুলো সহায়ক ভুমিকা পালন করবে। নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, সংলাপ শেষে প্রাপ্ত সুপারিশগুলো একীভূত করা হবে। যেসব সুপারিশ ইসির এখতিয়ারের মধ্যে থাকবে এবং অভিন্ন হবে-তা কমিশন একীভূত করবে। সেই সঙ্গে যেসব সুপারিশ এখতিয়ারের বাইরে রয়েছে, রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে সেগুলোও একীভূত করা হবে। সার্বিক সুপারিশ কমিশনের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করা হবে উল্লেখ করেন। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদাও বলেছেন, সংলাপ শেষে সবার প্রস্তাব একীভূত করে আমরা একটি প্রতিবেদন করবো। আমাদের করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে আমরা বসবো। যেসব বিষয় আমাদের এখতিয়ারে নেই সেগুলোর বিষয়ে সরকারের কাছে প্রয়োজনে পাঠানোর জন্যে ব্যবস্থা করা হবে। এদিকে ইসির সংলাপে নতুন কিছু প্রস্তবনা বিভিন্ন রাজনৈকি দলগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে যা আগে কখনো বিবেচনায় আনা হয়নি। বিশেষ করে নতুন নিবন্ধন পাওয়া সাংস্কৃতিক মুক্তি জোটের পক্ষ থেকে বিদায়ী ইসিকে নিয়ে নতুন ইসি পুনর্গঠনে জতীয পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া ধর্মভিত্তি একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসকের পরিবর্তে অতিরিক্ত জেলা জজকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নিযক্তির প্রস্তবনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিকল্প ধারা পক্ষ থেকে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভুমিকা পালনের নিশ্চয়তার রক্ষার্থে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতৃাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রস্থ ছুয়ে শপথ করার প্রওস্তাব দেয়া হয়েছে। এদিকে রাজনৈতিক দলের সংলাপে শেষ দিনে নির্বাচন কমিশন সকাল ১১টায় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি জেপিার সঙ্গে সংলাপ করে। বেলা ৩টায় অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপির সঙ্গে সংলাপে বরেস তারা। সংলাপে জাতীয় পার্টির জেপির পক্ষ থেকে আগামী নির্বাচন নিয়ে ৮ দফা প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। সংলাপ শেষে দলটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে ভোটের পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমাদের বক্তব্য তো সংবিধানের বাইরে যাবে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বারবার যেখানে আঘাত করা হয়েছে, সেখানে আমাদের একটা স্ট্যান্ড ছিল। আমাদের অবস্থান নির্বাচনের পক্ষে। আগামীতে ‘ভালো নির্বাচন হোক সেই প্রত্যাশা করেন তিনি। সংলাপে দলের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। অপর দিকে এলডিপি পক্ষ থেকে সংসদ ভেঙ্গে নির্বাচন দেয়াসহ মোট ১২ দফা প্রস্তবনা দেয়া হয়েছে। এতে নির্বাচনে ১৫ দিন আগে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কথ বলা হয়েছে। বেলা তিনটায় দলের সভাপতি অলি আহমেদের নেতৃত্বে দলের ২১ সদস্যের একটি প্রতিনিধি সংলাপে অংম নেয়। সংলাপে শেষে দলের সভাটপতি বলেন, ভোটের ১৫ দিন আগ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে সেনা মোতায়েন অপরিহার্য। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সেনার তদারকি ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরূপ ক্ষমতা দেয়া জরুরি। তবে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব না থাকলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে দেশের প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়নের আহ্বান জানান অলি আহমেদ। গত ৩১ জুলাই থেকে শুরু হয় ইসির সংলাপ। আগামী ২৪ অক্টোবর শেষ হচ্ছে প্রায় দুই মাস ব্যাপি চলা এই সংলাপ। আগামী রবিবার পর্যবেক্ষক সংস্থা, ২৩ অক্টোবর নারী নেতৃত্ব এবং ২৪ অক্টোবর নির্বাচন ভিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সংলাপে বসছে ইসি। আগামী ডিসেম্বরের সংলাপে সুপারিশমালা চূড়ান্ত করবে ইসি।
×