ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনীর রায় রিভিউয়ে ১১ সদস্যের প্যানেল

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২১ অক্টোবর ২০১৭

ষোড়শ সংশোধনীর রায় রিভিউয়ে ১১ সদস্যের প্যানেল

আরাফাত মুন্না ॥ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সুপ্রীমকোর্টে বাতিলের রায়ের রিভিউ (পুনঃবিবেচনা) আবেদনের জন্য পুরোদমে কাজ করছে রাষ্ট্রপক্ষ। এ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছে ১১ সদস্যের আইনজীবী প্যানেল। উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এনেছিল সরকার, যা হাইকোর্ট বাতিল করার পর সুপ্রীমকোর্টেও হাইকোর্টের রায় বহাল থাকে। শুক্রবার এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, এটা অনেক বড় একটি রায়। এ রায়ের বিরুদ্ধে আমরা রিভিউয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ লক্ষ্যে ১১ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমিসহ ১১ আইন কর্মকর্তা এ কাজে যুক্ত রয়েছি। কমিটিতে দুজন অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল ও আট ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল রয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, আদালতের দৈনন্দিন কাজ শেষ করে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে রাত প্রায় নয়টা-দশটা পর্যন্ত এ কমিটি এ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের লাইব্রেরিতে বসে আইনী তথ্যউপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণসহ এ সংক্রান্ত কাজগুলো করছে। সরকারের সিদ্ধান্ত এলেই যথাসময়ে রিভিউ আবেদন দাখিল করা হবে বলেও তিনি জানান। কবে এ কমিটি গঠন করা হয়েছে জানতে চাইলে এ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বেশ কয়েকদিন আগেই এ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে।’ এর আগে ১২ অক্টোবর এ্যাটর্নি জেনারেল জানান, আমরা রায়ের সার্টিফায়েড কপি (সত্যায়িত অনুলিপি) পেয়েছি। আইন অনুযায়ী রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার এক মাসের মধ্যে রিভিউ করতে হয়। আইন মন্ত্রণালয় যেভাবে নির্দেশ দেবে সে মোতাবেক কাজ শুরু হবে বলেও তিনি জানান। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন নয় আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল জারি করে। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট। তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন। রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করলে গত ৮ মে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই আপীল আবেদনের শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। পাশাপাশি এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রীমকোর্টের ১০ আইনজীবীর বক্তব্যও শোনে আপীল বিভাগ, যাদের মধ্যে একজন বাদে অন্য সবার কথায় হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ পায়। গত ২ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেই রায় দেয় আপীল বিভাগ। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় গত ১ আগস্ট। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেনÑ বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে দেখা যায়, রায়ের আদেশের অংশে আপীল বিভাগের বিচারপতিরা সর্বসম্মত হলেও পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সর্বসম্মত হতে পারেননি। রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি অনেক অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য তুলে ধরেন। জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে সমালোচনা করা হয় সুপ্রীমকোর্টের এ রায়ে। মামলার বিবেচ্য বিষয় নয় বলে প্রধান বিচারপতির লেখা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সরাসরি দ্বিমত পোষণ করে রায় লিখেছেন আপীল বিভাগের ওই বেঞ্চের দুই বিচারপতি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। সুপ্রীমকোর্টের এ রায় প্রকাশের পর প্রধান বিচারপতির লেখা অংশ নিয়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপশি সাধারণ জনগণের মধ্যেও ক্ষোভ প্রকাশ পায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির রায়কে ভ্রমাত্মক বলেও মন্তব্য করেছেন। জাতীয় সংসদেও এ রায়ের সমালোচনা করা হয়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। ওই প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের এ রায় দিয়েছে। সংসদ ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এ রায় দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সরকারপ্রধান। রায় নিয়ে সমালোচনার মুখে বিচারপতি সিনহা আদালতে শুনানিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অযোগ্য ঘোষণা করে সে দেশের সুপ্রীমকোর্টের রায় দেয়ার পরের পরিস্থিতির দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছিলেন, বিচার বিভাগ যথেষ্ট ধৈর্য ধরেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করায় নতুন করে সমালোচনার প্রেক্ষাপটের পরে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে তিনি বলেন, তাকে মিসকোট করে প্রকাশিত বক্তব্যের কারণে তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। গত ১৬ আগস্ট ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল সাংবাদিকদের জানান, রায়ের পূর্ণাঙ্গ সার্টিফায়েড কপি (সত্যায়িত) চেয়ে আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর গত ১০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক। গত ১৮ আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পুনঃবিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করতে সরকার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি। মন্ত্রী বলেছিলেন, রায়ের সত্যায়িত কপির জন্য আবেদন করা হয়েছে। রায় ভালভাবে পড়া হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই রিভিউ আবেদন করা হবে।
×