ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

আড়াই বছরে ৪২ তরুণীর আত্মহত্যা

থামছে না ইভটিজিং, অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ১৫ অক্টোবর ২০১৭

থামছে না ইভটিজিং, অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ বখাটের উৎপাত সইতে না পেরে শুক্রবার গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে শামসুন নাহার চাঁদনী (১২) নামের এক ছাত্রী। সে খুলনার সরকারী করোনেশন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। জানা গেছে, প্রতিবেশী শুভ প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসার পথে চাঁদনীকে উত্ত্যক্ত করত। শুক্রবার বিকেলে শুভ তার ৭ জন সহযোগীকে নিয়ে চাঁদনীর বাসায় যায়। এ সময় চাঁদনীর বাবা রবিউলের সঙ্গে তাদের কথা কাটাকাটি হয় এবং বখাটে শুভ তাকে মারপিট করে। এক পর্যায়ে চাঁদনীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। রাতে শুভ তার মাসহ দলবল নিয়ে চাঁদনীদের বাসায় গিয়ে তার বাবাকে অপমান করায় চাঁদনী আত্মহত্যা করে। ইভটিজিংয়ের কারণে চাঁদনীর মতো অনেক কিশোরী অকালে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। দেশে ইভটিজিংয়ের মতো ঘটনা কোনভাবেই কমছে না। এর ফলে নারীরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি বাধ্য হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। এক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালীদের দাপট অনেকাংশে দায়ী। ক্ষেত্র বিশেষে অভিভাবকদের অবহেলাও কম দায়ী নয়। ইভটিজিংয়ের প্রকোপে মাঝে মধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতকেও তৎপর হতে দেখা যায়। এমন অপরাধের সঙ্গে বেশিরভাগই স্থানীয় রাজনৈতিক বা প্রভাবশালীদের বখাটে সন্তানরা জড়িত থাকে বলে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় বলে অভিযোগ নারী নেত্রীদের। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের করা একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আড়াই বছরে ইভটিজিং বা প্রেমের নামে ছেলেদের হাতে উত্ত্যক্ত বা হয়রানির শিকার হয়ে ৪২ জন তরুণী আত্মহত্যা করেছেন। উত্ত্যক্তকারীদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার কোন উপায় না পেয়েই সাধারণত ওই মেয়েরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। প্রকাশিত রিপোর্টটিতে বলা হয়, ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৭৭৫টি ইভটিজিংয়ের খবর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এসব ঘটনার বিচারের হার খুবই নগণ্য। চলতি বছরের কেবল মে মাসেই ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ২১টি। এর মধ্যে আত্মহত্যা করে ২ তরুণী। এ ছাড়াও চলতি বছরের বিগত নয় মাসের মধ্যে পাঁচ মাসে ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ১৮০টি এবং উত্ত্যক্তের কারণে ২৫ তরুণী আত্মহত্যা করে। গত বছর ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ৩১৮টি। এর মধ্যে আত্মহত্যা করে ১১ জন তরুণী। ২০১৫ সালে ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে ৩২৮টি ও আত্মহত্যা করে ২২ জন তরুণী। এভাবে পেছন দিকে নজর দিলে আত্মহত্যার রেকর্ড কোনক্রমেই কম নয়। চলতি মাসের ৮ অক্টোবর বগুড়ায় বখাটের ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে রোজিফা আক্তার সাথী (১৫) নামের এক কিশোরী আত্মহত্যা করে। সে স্থানীয় জিয়ানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। জানা গেছে, রোজিফা ঘটনার দিন সকালে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় বখাটে হুজাইফাতুল ইয়ামিন (২০) তাকে উত্ত্যক্ত করে। ওই বখাটে তাকে মাস ছয়েক আগে থেকেই ইভটিজিং করে আসছিল। দিন দিন আরও বেশি উত্ত্যক্ত করতে থাকে সে। বখাটের উৎপাত সহ্য করতে না পেরে সে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। এ বিষয়ে মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু জনকণ্ঠকে জানান, নারী নির্যাতনের ঘটনা দেশে নতুন কিছু নয়। কিন্তু ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে তরুণীদের আত্মহত্যার ঘটনাকে তিনি অত্যন্ত উদ্বেগজনক উল্লেখ করে বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমে ইভটিজিংয়ের যতগুলো ঘটনা উঠে আসে, বাস্তবে ঘটছে তার চাইতেও অনেক বেশি। এ ছাড়া সব ঘটনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ বা মামলা করাও হয় না। এক্ষেত্রে প্রভাবশালীদের সম্পৃক্ততা থাকায় হুমকির মুখে ভুক্তভোগী অনেক পরিবারকে পড়তে হয়।’ ইভটিজিং প্রতিরোধকল্পে আইন পাস হয়েছে অনেক আগেই। আইনটির প্রয়োগ কতজনের ক্ষেত্রে ঘটেছে, সে সংক্রান্ত কোন তথ্য সকলেরই অজানা। এ ছাড়া নারীর সুরক্ষার জন্য শক্ত আইন রয়েছে। সমস্যা হলো, আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হয় না। আবার অনেকে এসব আইনের সুরক্ষা নিতে এগিয়ে আসেন না। এর কারণ বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, স্থানীয় প্রশাসনের অসহযোগিতা, উপযুক্ত আইনী সহায়তাদানের নিশ্চয়তা না পাওয়া ইত্যাদি। তবে ইভটিজিং রোধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক উদ্যোগ বেশি জরুরী বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী। এ বিষয়ে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ইভটিজিং কিশোরীদের জন্য কত বড় সমস্যা তা অভিভাবকরা বলতে পারবেন। আইন থাকলেও এসব বিদ্ঘুটে ঘটনাকে আইনের মধ্যে আনা আরও ঝামেলা। বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলোতে মেয়েরা এমনিতেই পড়ালেখা করার ক্ষেত্রে আর্থিক সঙ্কটে ভোগে। তার ওপর যদি বখাটেরা উত্ত্যক্ত করে, তাহলে তো কোন কথাই নেই। ওই মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। ইভটিজিংয়ের শাস্তি পায় নিরীহ মেয়েটি। এখানেই সমাজের কিছু করার রয়েছে। অপরাধী শাস্তি না পেয়ে পাচ্ছে নিরপরাধী। এটা মোটের ওপর অবক্ষয়। এই অবক্ষয় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সবাইকে দায়িত্ব নিতে হবে। প্রতিরোধ পাড়া, মহল্লা থেকেই তৈরি করতে হবে। ইভটিজিং প্রতিরোধে স্থানীয়দের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইভটিজারদের বিরুদ্ধে মামলার সাক্ষ্য দেয়ার লোক শেষ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। সামাজিক প্রভাব থাকলে কোন ছেলে উত্ত্যক্তকারী হতে চাইলেও ফিরে আসবে। গত বছরের নবেম্বরে ইভটিজিংয়ের ক্ষেত্রে স্কুল-কলেজেও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার নির্দেশনা দেয়া হয়। বিগত কয়েক বছর বিভিন্ন ঘটনার পর যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা জোরদারের সিদ্ধান্ত আসে গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বরের বিভাগীয় কমিশনারদের সমন্বয় সভা থেকে। ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা প্রশাসকদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অব্যাহত রাখা এবং জোরদারের নির্দেশ দেয়া হয়। ওই নির্দেশনার অংশ হিসেবে চলতি বছরের ১০ এপ্রিল ফেনী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে থেকে ৫ বখাটেকে আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরে মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেন ওই ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সোহেল রানা। এ ছাড়াও গত ১৯ এপ্রিল লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার বারাজান উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ইভটিজিং করার অপরাধে এরশাদুল ইসলাম নামে এক বখাটের ১ বছর কারাদ-াদেশ দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন অলিগলি ও যাত্রীবাহী পরিবহনে একের পর এক ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটলেও এ বিষয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতগুলোকে বেশি একটা তৎপর হতে দেখা যায় না।
×