ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুচির ভাষণ মিথ্যাচারে ভরা ॥ রোহিঙ্গা নেতা

প্রকাশিত: ০৬:১৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭

সুচির ভাষণ  মিথ্যাচারে ভরা ॥ রোহিঙ্গা নেতা

বিডিনিউজ ॥ রাখাইন সঙ্কট নিয়ে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি প্রকৃত সত্য লুকিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছেন বলে দাবি করেছেন রোহিঙ্গাদের এক নেতা। ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিলের (ইআরসি) প্রতিষ্ঠাতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ বলেছেন, রাখাইনে সেনাবাহিনী যে ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে, তা আড়াল করার প্রয়াস চালিয়েছেন সুচি, দিয়েছেন নানা ‘মিথ্যা তথ্য’। রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার প্রেক্ষাপটে এবার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে না গিয়ে মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর সুচি। তাতে তিনি কারও নাম না ধরে রাখাইনে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানান। ভাষণে রোহিঙ্গা শব্দটি তিনি উচ্চারণ করেননি; সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও সরাসরি কিছু বলেননি। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া আট লাখ রোহিঙ্গাকে শরণার্থীদের ‘যাচাই করে’ ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন সুচি। গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা ও পুলিশ চৌকিতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলার পর সেখানে অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসী দমনে এই অভিযান বলে তাৎক্ষণিকভাবে জানিয়েছিলেন সুচি। সেনা অভিযানে নির্বিচারে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও ধর্ষণ এবং ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে জানান আসা শরণার্থীরা। জাতিসংঘ একে রোহিঙ্গাদের ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ বলে আখ্যায়িত করে; নিন্দা আসে সারা বিশ্ব থেকে। এর মধ্যেই সুচির ভাষণের পর নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পক্ষে ইউরোপে জনমত গঠনে সক্রিয় ইআরসির নেতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ টেলিফোনে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, আমরা যা ধারণা করেছিলাম, তাই ঘটেছে। আউং সান সুচি মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। প্রথমেই তিনি ছায়া দিয়েছেন সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীকে, যারা গণহত্যা ঘটাচ্ছে। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকার কোন নিন্দা জানাননি; উপরন্তু দায়ী করেছেন রোহিঙ্গাদের। সেনা অভিযান সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়েছে বলে সুচির কথাও ঠিক নয় দাবি করে ইব্রাহিম বলেন, এই সপ্তাহেও সেনাসদস্যরা রোহিঙ্গাদের ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, কিন্তু আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী দলকে ভিসা দেয়া হচ্ছে না। রাখাইনে মুসলিমদের মতো অন্য সম্প্রদায়ও বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে সুচি যে কথা বলেছেন, তার প্রতিবাদ জানিয়ে রোহিঙ্গা নেতা বলেন, এটা মোটেই সত্য নয়। অন্য জনগোষ্ঠীগুলোকে সরকারী উদ্যোগে সরিয়ে নেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার যে কথা সুচি বলেছেন, তাও ‘মিথ্যা’ বলে দাবি করেন ইব্রাহিম। তিনি বলেন, সুচি তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বিসর্জন দিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান আসলে করবেন না। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও চাপ দিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান এই জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুত এই নেতা। দশকের পর দশক সামরিক শাসনে থাকা মিয়ানমার গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করেছে মোটে এক বছর আগে, এই পথে হাঁটতে গিয়ে নোবেলজয়ী সুচি সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস করে চলছেন বলে তার আন্তর্জাতিক মিত্ররাও মনে করছেন। দশকের পর দশক ধরে কয়েক লাখ শরণার্থীর ভার বহন করে আসা বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিয়ে তাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। ১৯৯২ সালে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির পর মিয়ানমার সোয়া দুই লাখের মতো রোহিঙ্গাকে ফেরত নিয়েছিল। তখন তাদের বলা হয়েছিল, ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’। এরপর আর প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগোয়নি। ভাষণে সুচি শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার প্রতিশ্রতি দেয়ার পাশাপাশি কেন তারা রাখাইন ছাড়ছে, তা খুঁজে বের করার কথা বলেন। ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সুচির উচিত হবে বাংলাদেশে এসে শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখা। তাহলে তিনি বুঝবেন, কেন তার দেশের এত নাগরিক পালিয়ে আসছে। তবে এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারের অনাগ্রহের বিষয়টি তুলে ধরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিছু দিন আগে সফরে এসেছিলেন। আমরা তাকে শরণার্থী শিবিরে যেতে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি রাজি হননি। চলমান সঙ্কট নিয়ে সুচির ভাষণের কোন প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে আসেনি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, শরণার্থী শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ে যৌথভাবে কাজ চালাতে মিয়ানমারকে দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সম্প্রতি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান বাংলাদেশ সবসময় দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সারতে চেয়েছিল, কিন্তু মিয়ানমারের কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে তাদের সুরক্ষার জন্য মিয়ানমারে একটি ‘সেইফ জোন’ করার প্রস্তাব দিয়ে আসছে।
×