ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

নিসর্গসখা দ্বিজেন শর্মা

তরু লতার ভাষা,বৃক্ষের সবুজে মিশে যাওয়া নাম

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭

তরু লতার ভাষা,বৃক্ষের সবুজে মিশে যাওয়া নাম

মোরসালিন মিজান সবাই খুব বৃক্ষপ্রেমী হয়ে উঠেছেন এমন নয়। তবে একটা পরিবর্তন কিন্তু এসেছে। এখন কংক্রিটের শহরে কোন রকমে বেড়ে ওঠা সামান্য গাছের দিকে অনেকেই মুগ্ধ হয়ে তাকান। রঙিন ফুলে যেমন আকৃষ্ট হন, তেমনি ঘন সবুজ পাতার মায়ায় পড়ে যান। ছোট পরিসর বাড়ির বারান্দায়, ছাদে কত রকমের গাছ তুলে এনেছে শহুরে মানুষ! চেনা গাছগুলো যথারীতি আছে। নিবিড় পরিচর্যায় বড় হচ্ছে। আছে অজানা অচেনা বৃক্ষকে জানার কৌতূহল। গাছের নাম কী? কী তার বৃত্তান্ত? জানা চাই। এবং এই জানার আগ্রহ সৃষ্টিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছিলেন দ্বিজেন শর্মা। মানুষের ভেতরে গাছের জন্য অদ্ভুত এক মায়ার বীজ বপন করেছিলেন তিনি। আজকের দিনে সবাই বড় বড় বিষয় নিয়ে থাকেন। দেশ দুনিয়া উদ্ধারে সে কী ব্যস্ততা! অথচ নিসর্গপ্রিয় মানুষটি তরুলতা নিয়ে ছিলেন। দীর্ঘ ৮৮ বছরের জীবন। প্রায় পুরোটাই তিনি কাটিয়েছেন বৃক্ষের সঙ্গে এবং অতঃপর বিদায়। তার প্রিয় বৃক্ষেরা অক্সিজেন দিয়ে চলেছে এখনও। শুধু বুক ভরে গ্রহণ করার মানুষটি বেঁচে নেই! বেঁচে নেই বটে। হারিয়ে যাননি। সবুজ শ্যামলীমার সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। নিজ হাতে লাগানো অসংখ্য গাছের পাতায়, মৌসুমি ফলে, নতুন নাম দেয়া ফুলের ঘ্রাণে মিশে আছেন তিনি। দ্বিজেন শর্মার উদ্ভিদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল শৈশবেই। তখন সিলেটে তিনি। মৌলভীবাজারের বড়লেখায় জন্ম। সবুজে ঘেরা প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠছিলেন। কিংবা প্রকৃতিই তাকে গড়ে তুলছিল নিজেদের মতো করে। পরবর্তী সময়ে বৃক্ষের সঙ্গে আরও আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছেন শুধু। নিবিড় সম্পর্কে জড়িয়েছেন। উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র হওয়ায় একইসঙ্গে চলেছে বৃক্ষ নিয়ে চর্চা ও বহুবিদ গবেষণা। এভাবে দেশের প্রায় সব বৃক্ষের নাম পরিচয় ও প্রয়োজনীয় তথ্য জানা হয়ে যায় তার। আবিষ্কার করেন বৃক্ষের ভাষা। প্রিয় গাছের হয়ে নিজেই বলেন। রচনা করেন অনেক পুস্তক। তার লেখার চরিত্র হয়ে উঠে বৃক্ষ। তরুলতার সহজ বর্ণনা দিয়ে চলেন। সৌন্দর্যগুলো খুঁটিয়ে দেখেন। দেখান। প্রকৃৃতি ও মানুষের আন্তঃসম্পর্কীয় বিষয় এবং পরস্পরের মধ্যকার সঙ্কটের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেন তিনি। তার কথা শুনে লেখা পড়ে বিশেষ ভালবাসার চোখে গাছকে দেখছে মানুষ। গাছকে গ্রহণ করছে মানুষ। তবে আরও বেশি কিছু চেয়েছিলেন তিনি। সব সময় পাননি। হয়ত তাই অভিমানী হয়ে লিখেছিলেন, ‘অনেক লিখেছি, কিন্তু বিশেষ কোন ফলোদয় হয়নি এবং শেষ পর্যন্ত এমন ধারণা জন্মেছে যে, আমাদের দেশে লিখে ব্যক্তিগত সুনাম কুড়ানো ব্যতীত কোন বাস্তব ফললাভ ঘটে না।’ প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, মানব সভ্যতা এখন বিপন্ন। প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মানুষ যেন প্রকৃতিকে বাদ দিয়েই চলতে চায়। মানুষের এই ব্যবহারে প্রকৃতি এখন রুষ্ট। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাতে মানুষের জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। আমাদের আরেকটি নতুন করে সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান থাকবে। এমন চিন্তা থেকে সারাজীবন নিজে কাজ করেছেন। বৃক্ষপ্রেমী দ্বিজেন শর্মা নিজ হাতে বহু বৃক্ষ রোপণ করেছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে এসব গাছ মাথা তুলে সুন্দর দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর ঢাকার বাসার বারান্দাজুড়ে গাছ। হলুদ গাঁদা গোলাপী অর্কিড ক্যাকটাস। ফলদ বৃক্ষ। সবই তার নম গাইছে এখন। নটরডেম কলেজের ক্যাম্পাস তো বার বার দেখা। ঢাকার এই কলেজের শিক্ষক ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। বিশাল ক্যাম্পাসজুড়ে গাছ লাগিয়েছিলেন তখন। বুধবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অসংখ্য জাতের বৃক্ষ। পরিণত বৃক্ষেরা ক্যাম্পাসের পরিবেশটাই কেমন আদুরে করে রেখেছে। যন্ত্রনগরীতে এমন অকৃত্রিম দৃশ্য দেখার অন্য রকম আনন্দ। প্রতিটি গাছের পাশে নাম লিখে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোন গাছগুলো দ্বিজেন শর্মার লাগানোÑ এখন আর বোঝার উপায় নেই। তবে সব গাছই যে দ্বিজেন শর্মার জন্য শোক করছে, অনুমান করা যায়। বহু কালের পুরনো বাগান রমনাপার্কে অগণিত গাছগাছালি। এর পরও এখানে নতুন নতুন গাছ এনে লাগিয়েছেন প্রকৃতিপুত্র। বাগানটিকে সমৃদ্ধ করতে প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না তার। ২০০৭ সালে এখানে তিনি পুঁতে দিয়েছিলেন দুলিচাঁপার একটি চারা। উদ্ভিদবিদের ছাত্র নিত্য সহচর সৌরভ মাহমুদের সহায়তায় বিরল গাছটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়। কয়েক বছরের ব্যবধানে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করেছে দুলিচাঁপা। ঘন আর বড় বড় পাতা। আশ্চর্য সবুজ পাতার গায়ে শরতের সোনালী রোদ কী যে সুন্দর খেলা করছিল! দেখে মন ভাল হয়ে যায়। পরোক্ষণেই বিষণ্নতা ভর করে মনে। নবীন এই গাছ কি জানে তার দিকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা নিয়ে তাকানোর মানুষটি আর নেই? তার হয়ে তাদের হয়ে যে দুঃখ ব্যথার কথা বলত, আর বলবে না। মাথা তুলে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়া দুলিচাঁপা কি পেয়েছে সে দুঃসংবাদ? ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় তিনি বৃক্ষরোপণ করেছেন। বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ ক্যাম্পাসে আছে তার নিজের হাতে লাগানো বৃক্ষ। একটি গাছের কথা জেনে তো অবাক হয়ে যেতে হলো। ১৯৬২ সালে গাছটি লাগিয়েছিলেন তিনি। সেই নাগলিঙ্গম হয়ত জানে, হয়ত জানে না যে, তার ভাষা বোঝার তাকে আগলে রাখার মানুষটি বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে! তবে রূপসী বাংলার সব গাছের পাতার দিকে ফুলের দিকে তাকিয়ে দ্বিজেন শর্মার নাম নেবে প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। এ কথা নিশ্চত করেই বলা যায়।
×