ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ব্যাপারীদের মনে বৃষ্টি আতঙ্ক

রাজধানীর হাটগুলো কোরবানির পশুতে সয়লাব

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

রাজধানীর হাটগুলো কোরবানির পশুতে সয়লাব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ কোরবানির পশুতে সয়লাব হয়ে গেছে রাজধানী ঢাকা। রাত পোহালেই পবিত্র ঈদ-উল-আযহা। আর এই উৎসবকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে কোরবানির পশুর হাট। প্রতিটি হাটেই উপচেপড়া কোরবানির পশু। সঙ্গে ক্রেতাও ঠাসা। দরকষাকষি শেষ। এবার কোরবানির পশু কিনে বাড়িমুখী হওয়ার পালা। হচ্ছেনও তাই। হাটের এ চিত্র বদলেছে বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে এক পশলা বৃষ্টির পর। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে অতিমাত্রায় পশুর সরবরাহ। রাজধানীর হাটে খবর রটেছে ভারতীয় গরু আসারও। তাই এদিন বিক্রিও বেড়েছে গত কয়েকদিনের তুলনায় অনেক বেশি। তবে সব ছাপিয়ে ব্যাপারীদের মনে ভর করছে ‘বৃষ্টি আতঙ্ক’। শেষ পর্যন্ত ভাল দাম পেয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন কি-না সেই আশায় রয়েছেন গরু ব্যবসায়ীরা। এদিকে রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলীতে বিপুলসংখ্যক পশু ওঠায় রাখার জায়গা পাচ্ছেন না বিক্রেতারা। একই চিত্র রাজধানীর অধিকাংশ হাটেরও। বৈধ হাটের সঙ্গে মিশে গেছে অবৈধ হাট। সকাল-সন্ধ্যা কিংবা মধ্য রাতে গরুবাহী ট্রাক এখনও রাজধানীতে ঢুকছে। হাটের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তায়, অলিগলিতেও পশু রাখা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কয়েকটি কোরবানির পশুর হাট ঘুরে দেখা গেল, সাধ আর সাধ্যের সমন্বয় ঘটিয়ে পছন্দের পশুটি কিনছেন ক্রেতারা। হাট শুরুর কয়েকদিনের খরা কাটিয়ে বৃহস্পতিবার থেকে কোরবানির পশু কিনছেন নগরবাসী। শুরুতে আকাশচুম্বী দাম হাঁকালেও শেষ পর্যন্ত মূল্যসীমাও কমিয়ে এনেছেন ব্যাপারীরা। তবে বিক্রি নিয়ে পুরোপুরি সন্তুষ্টির কথা শোনাতে পারলেন না বিক্রেতারা। ব্যাপারীরা জানালেন, রাজধানীর হাটগুলোতে এবার দেশী গরুতে ভরপুর। চাহিদাও এগুলোরই বেশি। প্রতিটি হাটে এখনও ট্রাক বোঝাই করে কোরবানির পশু আসছে। হাটের সীমানা ছাড়িয়ে আশপাশের রাস্তায়, অলিগলিতেও পশু রাখা হচ্ছে। অধিকাংশ হাটেই গরু রাখার নির্দিষ্ট জায়গা পূরণ হয়ে গেছে অনেক আগেই। ফলে আশপাশের সড়ক ও খালি জায়গা দখল করছেন ব্যাপারীরা। কোন কোন হাট নির্দিষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। অস্থায়ী হাট চলে এসেছে মূল সড়কে। গাবতলীর মূল হাট ছেড়ে ট্রাকস্ট্যান্ডসহ আশপাশের সড়কের পাশে গরু রাখা হয়েছে। শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনিসংলগ্ন মৈত্রী সংঘের মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, মাঠের বাইরে চতুর্দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পশু রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলোনির প্রতিটি বাসার সামনে গরু বেঁধে রাখা হয়েছে। এতে করে বাড়ির বাসিন্দাদের দরজা দিয়ে বের হওয়াও মুশকিল হয়ে পড়েছে। মেরাদিয়া হাটে দেখা যায়, হাটটি মেরাদিয়া বাজার থেকে শুরু করে দক্ষিণ বনশ্রীর প্রজেক্ট এলাকার বিভিন্ন অলিগতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। মেরাদিয়া হাট থেকে কাজীবাড়ি পর্যন্ত সড়কের দুই পাশেই সারিবদ্ধভাবে গরু রাখা হয়েছে। এ সড়কটিতে আবাসিক এলাকার ২০টির মতো সংযোগ সড়ক রয়েছে। প্রতিটি সড়কেই বসানো হয়েছে হাট। কিছু কিছু এলাকায় পশু রাখার জন্য বাঁশ ও খুঁটি লাগানোর কাজ চলছে। এতে আশপাশের বাসাবাড়ি, দোকানপাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতে বিঘœ ঘটছে। এ ছাড়া ঢাকায় প্রবেশের বিভিন্ন মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটেও শত শত গরুর ট্রাক আটকা পড়ে আছে। এদিকে সীমান্তপথে ভারত, মিয়ানমার ও নেপাল থেকেও গরু আসার কথা জানিয়েছেন একাধিক হাটের ইজারাদাররা। ক্রেতারা বলছেন, হাটে যেহেতু কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি, তাই শেষ সময়ে দাম আরও কমে যেতে পারে। তবে বিক্রেতাদের দাবি, আগের চেয়ে পশুখাদ্যের দাম বেশি। বেড়েছে পরিবহন খরচও, তাই গরুর দাম একটু বেশিই রাখতে হচ্ছে। এদিকে গাবতলী হাটে আসা একাধিক ব্যাপারী অভিযোগ করে বলছেন, পথে পথে গরুর ট্রাকে চাঁদাবাজি হচ্ছে। কুষ্টিয়া থেকে ১৪টি গরু নিয়ে আসা নাসির উদ্দিন বলেন, পথে অন্তত পাঁচ জায়গায় বকশিশের নামে চাঁদা দিতে হয়েছে। একই অভিযোগ করেছেন উত্তরাঞ্চল থেকে রাজধানীতে গরু নিয়ে আসা খামারিরাও। কুষ্টিয়া থেকে গাবতলী হাটে গরু নিয়ে এসেছেন সামাদ ব্যাপারী। বৃহস্পতিবার বিকেলে দুটি গরু বিক্রি করেছেন তিনি। একটি ৮২ হাজার, অন্যটি ১ লাখ ৫ হাজার টাকায়। তার পরও খুশি নন এ ব্যাপারী। তার মতে, এবার লাভ দূরে থাক, আসল ওঠানোই দায় হয়ে পড়েছে। এবার বড় গরুর দিকে ক্রেতারা তেমন নজরই দিচ্ছেন না। বৃহস্পতিবার হাটের এপাশ-ওপাশ ঘুরে কোরবানির গরু কিনেছেন অনেক ক্রেতাই। এদিন দুপুরে ৭৮ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন হারুন-অর-রশিদ নামের এক ক্রেতা। এর আগে টানা তিনদিন হাটে এসেছিলেন তিনি। জানালেন, চড়া দামের কারণে গরু কেনা হয়নি। তিনি জানান, এখন দাম একটু কমতির দিকে থাকায় ভালো দামেই গরু কিনেছি। গাবতলী হাটে ক্রেতাদের চাপ দেখা গেছে হাটের বর্ধিতাংশে ও গাবতলী থেকে রায়েরবাজারে যাওয়ার রাস্তার দুপাশের অতিরিক্ত হাটের অংশে। মূল হাটে কোরবানি অনুসারে তেমন একটা চাপ লক্ষ্য করা যায়নি। বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে বৃষ্টির কারণে হাটের ভেতরে যাওয়ার রাস্তা কাদা ও গরুর বর্জ্যে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের। মোহাম্মদপুর থেকে আসা সুমন মিয়া জানান, হাটের ভেতরের অংশে বাধ্য হয়ে এসেছি। আসার ইচ্ছে ছিল না। কারণ ভেতরে আসার রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু দামে বনিবনা না হওয়ার কারণে ভেতরে এসেছি। এখানেও একই অবস্থা। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ও ইজারাদারদের কোনো পরিষ্কার অভিযান লক্ষ্য করা যায়নি এ হাটে। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর থেকে চারটি গরু নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে এসেছেন রহিম সরকার। ঘরে পালা দেশী গরুগুলোর দাম চাচ্ছেন প্রত্যেকটি ১ লাখ টাকার উপরে। তিনি জানান, আমার সঙ্গে আরও একজন ব্যাপারী ১৩টা গরু নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে ফিরে গেছেন। আমি হাটের ভেতরে দাঁড়ানোর জায়গা পাইনি। তবুও থেকে গেছি কারণ আমার গরুর যে দাম তা অনুসারে এ হাটেই বিক্রি করতে পারব স্বাচ্ছন্দ্যে। অন্য হাটে গেলে ইচ্ছা অনুযায়ী দাম পাব না। আরেক ব্যাপারী শাহ আলম বলেন, ভেতরের হাটে যাওয়ার রাস্তায় গোড়ালি সমান কাদা তাই ক্রেতারা ভেতরে যেতে চাইছে না। কোরবানির পশুর দাম বেশি তার কারণ জিজ্ঞাসা করলে এই ব্যাপারী আরও বলেন, আমরা এক একজন ব্যাপারী অনেকদিন ধরে হাটে অবস্থান করছি কিন্তু এবার হাটে ক্রেতাদের দেখা মিলেছে আজকে মাত্র। এই ক’দিন থাকা খাওয়ায় অনেক খরচ হয়েছে। এবার গরু আনতে ট্রাকের ভাড়াও বাড়তি ছিল এছাড়া খাবারের দামও অনেক বাড়তি। নিজের পালা পাঁচটি গরু নিয়ে এই হাটে মঙ্গলবার ভোরে এসেছেন কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, আশা করছিলাম লাখ টাকার ওপরে গরু বিক্রি করব। কিন্তু কেউ ৮০ হাজার টাকার বেশি বলে না। তবে শেষ পর্যন্ত ভারতীয় গরু না এলে ভাল দাম পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন এই বিক্রেতা। চুয়াডাঙ্গার আলম ডাঙ্গা থেকে গত রবিবার ২৬টি মাঝারি ও বড় সাইজের দেশীয় গরু কমলাপুর হাটে এনেছেন ঝন্টু মিয়াসহ আরও ৩ জন ব্যাপারী। সব গরু তাদের নিজস্ব খামারে পালিত। জানতে চাইলে বলেন, প্রতিটি গরু ২ লাখ থেকে শুরু করে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রির টার্গেট রয়েছে তাদের। ঝন্টু জানায়, আড়াই লাখ টাকার গরুর দাম করছেন ক্রেতারা ১ লাখ ৬০ হাজার। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর দাম সন্তোষজনক নয় উল্লেখ করে হতাশার কথা শোনালেন ঝিনাইদহ থেকে ১২টি গরু নিয়ে আসা গোলাম নবী। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, গত শনিবার ট্রাকে করে গরু এনেছি। এ পর্যন্ত মাত্র ৪টি গরু বিক্রি করতে পেরেছি। আজ শুক্রবারের মধ্যে সব গরু ভাল দামে বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন এ ব্যাপারী। খিলগাঁও থেকে কমলাপুর হাটটিতে গরু কিনতে আসা ফয়েজ উদ্দিন ম-ল জানান, ব্যাপারীরা গরুর যে দাম চাচ্ছেন, আসলে সেই গরুগুলো এত দামের না। বিক্রেতার চাওয়া আড়াই লাখ টাকা দামের একটি গরু দেখিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ওই গরুটি প্রকৃত দাম ১ লাখ ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা হতে পারে। কিন্তু এটির দাম অনেক বেশি চাওয়া হয়েছে। ফলে গরু এখনো ক্রয় করিনি। ঈদের আগেরদিন গরু কেনার কথা জানালেন এ ক্রেতা।
×