ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতির আয়নায় ঝলমলে নায়করাজ রাজ্জাক, হয়ে আছেন অম্লান

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ২৭ আগস্ট ২০১৭

স্মৃতির আয়নায় ঝলমলে নায়করাজ রাজ্জাক, হয়ে আছেন অম্লান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ এসেছিল সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাই তুমি করে গেলে দান ...। এমনটাই যেন ঘটেছে নায়করাজ রাজ্জাকের প্রস্থানে। ঢাকাই ছবির এই মহানায়ক মৃত্যুকে আলিঙ্গনের মাধ্যমে চিরবিদায় নিলেও আপন কীর্তিতে হয়ে আছেন অম্লান। সেই কীর্তির কথা বারংবার উচ্চারিত হচ্ছে তার সহশিল্পীদের কথায়। সেলুলয়েডে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি স্মরণে আসছে ভক্ত ও অনুরাগীদের। শরীরী অস্তিত্ব হারিয়েও কর্মের আলোকে এভাবেই স্মৃতির আয়নায় ঝলমলরূপে হাজির হচ্ছেন নায়করাজ। শনিবার সকালে বিএফডিসির আট নম্বর শূটিং ফ্লোরে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার আয়োজিত শোকসভায় স্বমহিমায় উপস্থিত হলেন এই কিংবদন্তি শিল্পী। তার অভিনীত ছবির চিত্রনায়িকা থেকে শুরু করে সহশিল্পী, পরিচালক ও প্রযোজকরা স্মরণ করলেন দেশের সর্বোচ্চ জনপ্রিয় এই শিল্পীকে। কিংবদন্তির চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবির মাধ্যমে রূপালি পর্দায় প্রথম নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন রাজ্জাক। সেই ছবিতে রাজ্জাকের নায়িকা হয়েছিলেন সুচন্দা। ঢাকাই ছবির সোনালি সময়ের এই চিত্রনায়িকা রাজ্জাককে মূল্যায়ন করতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হলেন। কান্নাভেজা কণ্ঠে বললেন, নিষ্ঠা ও শ্রম দিয়ে তিলে তিলে চলচ্চিত্র শিল্পে নিজের অনন্য অবস্থানটি তৈরি করেছেন রাজ্জাক। এমন সহজাত অভিনেতা ছিলেন যে অভিনয়ের সময় চোখে, মুখে ও ঠোঁটেও অভিব্যক্তি মেলে ধরতেন। তাই যে কোন চরিত্রকেই সহজ করে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। বেহুলা ছবিতে প্রথম নায়কের চরিত্রে অভিনয়ের পর তাকে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ধ্রুবতারা। সাংবাদিক আহমদ জামান চৌধুরী তাকে যথার্থই নায়করাজ উপাধি দিয়েছিলেন। জহির রায়হানের স্ত্রী ও সহকর্মী হিসেবে তিনি আমাকে সব সময় সম্মান করেছেন। আনুমানিক ২০ থেকে ২৫টি ছবিতে কাজ করেছি তার সঙ্গে। অনেক সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়ানো বিকেল পেরিয়ে রাত অবধি একসঙ্গে শূটিং করেছি। এরপর জহির রায়হানকে হারানোর পর চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে যাওয়ায় তার সঙ্গে আর কাজ করা হয়নি। তার দেখানো পথে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের নায়করা পথ চলবে, এটাই প্রত্যাশা করি। শোকসভায় নায়করাজের পরিবারের পক্ষে কথা বলেন তার দুই ছেলে বাপ্পারাজ ও সম্রাট। রাজ্জাককে নিবেদিত আলোচনা ও স্মৃতিচারণ করেছেন তার অনুজ চিত্রনায়ক এবং বন্ধুতুল্য সহকর্মী ফারুক, আলমগীর ও সোহেল রানা। কথা বলেছেন রাজ্জাকের সঙ্গে নায়িকা হিসেবে রূপালি পর্দায় হাজির হওয়া সুজাতা ও রোজিনা। ছিলেন নন্দিত অভিনেত্রী ও সাবেক চিত্রনায়িকা চম্পা। কথনে অংশ নিয়েছেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন, চলচ্চিত্র শিল্পী নূতন, দিলারা, অরুণা বিশ্বাস, ওমর সানী, বিএফডিসির এমডি তপন কুমার ঘোষ, শিল্পী সমিতির সভাপতি মিশা সওদাগর, প্রযোজক নেতা খোরশেদ আলম খসরু, চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সভাপতি ইফতেখার উদ্দীন নওশাদ, চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থার সভাপতি আব্দুল লতিফ বাচ্চু, পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজারসহ অনেকে। স্মরণসভা সঞ্চালনা করেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস, জায়েদ খান এবং প্রযোজক ও পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জেমি। সন্তান হিসেবে বাবা সম্পর্কে ওঠা কিছু ভুল ধারণা ও সমালোচনার জবাব দিয়ে বাপ্পারাজ বলেন, রাজ্জাকের জীবনটা একটা খোলা বইয়ের মতো। উত্তরায় রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্স নিয়ে একটা ভুল ধারণা আছে যে, উনি সিনেমা হলের নাম করে মার্কেট করেছেন। প্রকৃত বিষয়টি হচ্ছে মার্কেটের কথা বলেই অনুমতি নেয়া হয়েছিল। পরে আমরা সিনেমা হল করার চেষ্টা করলেও রাজউক থেকে অনুমতি মেলেনি। আর ওই ভবনটায় অনেক পিলার ছিল। সেটা ভেঙ্গে জায়গা বের করে সিনেমা হল করার কোন উপায় ছিল না। এই হলো ঘটনা। রাজ্জাক সাহেব দুই নম্বরি করে মার্কেট বানাননি, রাজ্জাক সাহেব সৎ থেকে মার্কেট বানিয়েছেন। রাজ্জাক সাহেব যদি দুই নম্বরি করে বানাতেন, তাহলে উত্তরায় আরও চার-পাঁচটা মার্কেট থাকত। করেননি। সৎ থাকার কারণে নিজেদের বাড়ির একটা অংশ বিক্রি করে দিতে হয়েছিল জানিয়ে বাপ্পারাজ বলেন, আমাদের এত বড় একটা বাড়ি ছিল, ব্যবসায় ক্ষতি করার পরে ব্যাংকের মাত্র চার কোটি টাকা ঋণ ছিল। লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকা মানুষ মেরে দেয়, আবুল-করিম-গফুররা এমন করে, কোন কথা ওঠে না কখন। কিন্তু রাজ্জাক সাহেবের নামে আসবে, রাজ্জাক সাহেব চার কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন, ব্যাংকে ডিফল্টার হবেন তেমনটা হয়নি। আমরা বাড়ি বিক্রি করে ঋণ শোধ করেছি। আমরা অসৎ হলে মেরে দিতে পারতাম ওই টাকা। আরও বাড়ি করতে পারতাম, ডেভেলপার দিয়ে ফ্ল্যাট বানাতাম। একপর্যায়ে বাপ্পারাজ বলেন, চলচ্চিত্র শিল্পে বর্তমানে নিষিদ্ধ খেলা চলছে। এটা বন্ধ করতে হবে। আপনারা যদি সকল নিষেধাজ্ঞা, মামলা তুলে না নেন তাহলে এফডিসিতে আর আসব না। হয়ত এটাই হবে আপনাদের সঙ্গে শেষ দেখা। আমজাদ হোসেন বলেন, এফডিসির দূর্বাঘাস থেকে শুরু করে প্রতিটি ভবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজ্জাকের স্মৃতি। তিনি ছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ। পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম থাকে। কীর্তির কারণে যে মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকা যায় সেটাই দেখিয়েছেন রাজ্জাক। আগামী দিনে আরও বেশি মূল্যায়িত হবেন তিনি। সোনালি সময়ের নায়িকা সুজাতা বলেন, রাজ্জাকের বিপরীতে আমার প্রথম রোমান্টিক ছবি ‘আগুন নিয়ে খেলা’ দারুণ হিট হয়েছিল। তার বাসায় তুমুল আড্ডার কথা আজো মনে পড়ে। একুশে আগস্ট আমরা এই মানুষটিকে হারালাম। নোংরামি দূর করে এফডিসির সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে এনে এই হারানো মানুষটির প্রতি আমাদের ভালবাসা জানাতে হবে। রাজ্জাকের প্রতি অপার অনুরাগ প্রকাশ করে আলমগীর বলেন, ১৯৭২ সালে তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। মাঝে বয়ে গেছে ৪৫ বছর। কখনও বড় ভাই, কখন পথপ্রদর্শক, কখনও, সহশিল্পী হিসেবে তার হাত ধরে চলেছি। ছোটদের জন্য বড়দের আচরণ কেমন হওয়া উচিত তার উদাহরণ ছিলেন রাজ্জাক। তিনিই আমাকে চলচ্চিত্রকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। প্রতিকূল আবহাওয়ায় পাখির মতো উড়তে শিখিয়েছেন। ফারুক বলেন, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রাজ্জাকের সঙ্গে গড়ে উঠেছে আমাদের রক্তের বন্ধন। আমার কাছে তিনি বড় ভাই। চাইলেই শিল্পী হওয়া যায় না, শিল্পী হয়ে যায়। সেই শিল্পী ছিলেন রাজ্জাক। এফডিসিতে রাজ্জাকের একটি প্রতিকৃতি এবং তার নামে একটি শূটিং ফ্লোরের নামকরণের অনুরোধ জানান রোজিনা। বলেন, রাজ্জাক সাহেবকে দেয়ার মতো আমাদের কিছুই নেই। উনিই বরাবর আমাদের দিয়ে গেছেন। সুতরাং আজ এই সামান্য কাজটা করে আমরা আমাদের নায়ককে সম্মান জানাতে পারি। এই নায়িকা আরও বলেন, বাংলা চলচ্চিত্র যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবেন নায়করাজ রাজ্জাক। শুধুই নায়কই ছিলেন না, আমাদের কাছে একটি প্রতিষ্ঠান ছিলেন রাজ্জাক। ছিলেন আমাদের সবার অভিভাবক। শোকসভার পর রাজ্জাকের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। রাজ্জাককে নিবেদিত এফএফএসবির স্মরণসভা সকালের শোকসভার পর বিকেলে নায়করাজ রাজ্জাকের স্মরণে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সম্মেলন কক্ষে স্মরণসভার আয়োজন করে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ অব বাংলাদেশ (এফএফএসবি)। নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, নায়করাজ রাজ্জাক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের অন্যতম সুহৃদ ছিলেন। বাণিজ্যিক ঘরানার চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় তারকা হওয়ার পরও চলচ্চিত্রের শৈল্পিক এবং নান্দনিক আন্দোলনে সক্রিয় থাকার তার এই প্রয়াস স্বাভাবিকভাবেই বিরল দৃষ্টান্ত। এফএফএসবির সভাপতি লাইলুন নাহার স্বেমির সভাপতিত্বে স্মরণসভায় প্রধান আলোচক ছিলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। স্মরণ ও স্মৃতিতর্পণে অংশ নেন চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন, সি বি জামান, চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ, হায়দার রিজভী, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, ফাহমিদুল হকসহ প্রবীণ-নবীন চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র শিক্ষক-গবেষক এবং চলচ্চিত্রকর্মীবৃন্দ। আলোচনার সূত্রপাত করেন এফএফএসবির সাধারণ সম্পাদক বেলায়াত হোসেন মামুন। স্মরণসভায় প্রদর্শিত হয় নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত দুটি চলচ্চিত্র । এর একটি ছিল জহির রায়হান নির্মিত ‘আনোয়ারা’ ও নারায়ণ ঘোষ মিতা নির্মিত ‘আলোর মিছিল’। চলচ্চিত্র দুটি দেখানো হয় একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল কালচারাল আর্কাইভে।
×