ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি চরমে ॥ ভেঙ্গে গেছে ১০ বাঁধ, মৃত্যু ১৬

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ১৪ আগস্ট ২০১৭

উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি চরমে ॥ ভেঙ্গে গেছে ১০ বাঁধ, মৃত্যু ১৬

জনকণ্ঠ ডেস্ক ॥ গত কয়েক দিনের অব্যাহত ভারি বর্ষণ এবং উজানের ঢলে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। এতে দুটি শহর রক্ষা বাঁধসহ অন্তত ১০টি বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। বিভিন্ন স্থানে পানিতে ডুবে মারা গেছে শিশু ও গৃহবধূসহ অন্তত ১৬ জন। নিখোঁজ রয়েছে কমপক্ষে আটজন। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বন্যার্তদের সহায়তায় দিনরাত অবিরাম কাজ করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত দেশের সব সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল ঘোষণা করেছে সরকার। তিস্তায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় রেড এ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এসব জেলায় আট বাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৫০ হাজার পরিবারের প্রায় ২০ লাখ মানুষ। দিনাজপুর সদর উপজেলায় শহররক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে পড়ায় পানিবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে কয়েক লাখ মানুষ। এখানে গত দুই দিনে অন্তত আটজনের মৃত্যু হয়েছে এবং নিখোঁজ রয়েছে আরও দুজন। কুড়িগ্রামে মারা গেছে চারজন এবং নিখোঁজ রয়েছে দুজন। এছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ে পানিবন্দী অবস্থায় আটকা পড়ে আছে হাজার হাজার মানুষ। পীরগঞ্জে আতঙ্কে মৃত্যু হয়েছে এক গৃহবধূর। নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এ জেলায় নিখোঁজ রয়েছে একজন। নওগাঁ, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, সৈয়দপুর ও রাঙ্গামাটিতে বন্যায় ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। বন্যাকবলিত এসব জেলায় বিশুদ্ধ খাবার পানির চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া রয়েছে ত্রাণের অভাব। কয়েকটি বিদ্যালয়ে পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। খবর স্টাফ রিপোর্টার, নিজস্ব সংবাদদাতা ও বিডিনিউজের। স্মরণকালের উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে গর্জে উঠেছে তিস্তা। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের ৫৪টির মধ্যে ৩৫টি লগগেট খুলে দেয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান। শনিবার রাতে রেড এ্যালার্ট জারি করা হয় তিস্তা অববাহিকায়। বন্যা ও অবিরাম বর্ষণে ৫০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। চরম দুর্ভোগে রয়েছে ২০ লাখ মানুষ। রবিবার সকাল ৬টা হতে তিস্তার পানি নীলফামারীর ডিমলার ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তবে বিকেল তিনটায় ঢল কমে আসায় পানি বিপদসীমার ৪০ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এলাকাবাসীর মতে ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৭ সালের বন্যাকে ছাড়িয়ে গেছে ২০১৭ সালের ১৩ আগস্টের এই উজানের ঢলের বন্যার ভয়াবহতা। পানির প্রবাহ বেশি হওয়ায় ডালিয়া ব্যারাজ হুমকির মুখে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তবে সকাল সাড়ে নয়টায় পাউবো কর্তৃপক্ষ ব্যারাজ সংলগ্ন ফ্লাড বাইপাসটি কেটে দিতে গেলে লোকজনের বাঁধার মুখে কাটতে পারেনি। দিনাজপুর ॥ প্রবল বৃষ্টি ও ভারতের বাঁধ খুলে দেয়ায় সদর উপজেলার মাহুদপাড়া ও সুন্দরা এলাকায় শহররক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে গেছে। এতে শহরের বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক জানান, বন্যার কারণে শনিবার সন্ধ্যা থেকে রবিবার দুপুর পর্যন্ত জেলায় আটজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছে আরও দুজন। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার কয়েক লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে প্রায় দু লাখ একর ফসলি জমি। দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের তিনটি গোডাউনে পানি ঢুকে পড়ায় কোটি টাকার জেএসসি পরীক্ষার খাতা ও ওএমআর পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম ॥ অবিরাম বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। কুড়িগ্রামে ১৬টি নদ-নদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কুড়িগ্রাম শহর থেকে নাগেশ^রী, ফুলবাড়ী এবং ভুরুঙ্গামারীর যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় চারজনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। নেত্রকোনা ॥ পাহাড়ী ঢলে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার নিম্নাঞ্চলে প্লাবিত হয়েছে। দুর্গাপুরে সাতটি এবং কলমাকান্দার আটটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। কলমাকান্দার বড় সিধলী গ্রামের আব্দুল আজিজ (৬০) পাহাড়ী ঢলের সঙ্গে আসা কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। ঠাকুরগাঁও ॥ ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে ঠাকুরগাঁওয়ের পাঁচ উপজেলার হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রায় পাঁচ হাজার পরিবার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে চিড়া, গুড়, মোমবাতি এবং মশা তাড়ানোর কয়েল সরবরাহ করা হয়েছে। জয়পুরহাট ॥ জয়পুরহাটের চার নদীর পানি দ্রুতগতিতে বাড়তে শুরু করেছে। পানি বাড়ায় তুলসীগঙ্গা ও ছোট যমুনার দুই পাড়ে প্রায় ৩১ কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সদর উপজেলার বম্বু ইউনিয়নের সতীঘাটা ও ক্ষেতলালের ঘোরামাটির বিলের ঘাটে বাঁধের দুই জায়গায় কিছুটা ফাটল দেখা দেয়ায় বালুর বস্তা ফেলা শুরু হয়েছে। যেকোন সময় বাঁধ ভেঙ্গে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। রবিবার পাঁচবিবির নয়াপাড়ায় একটি সেতুর ওপর থেকে লুৎফর রহমান নামে এক যুবক নদীতে পড়ে গেলে পানির প্রবল স্রোতে তিনি তলিয়ে যান। পরে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। লালমনিরহাট ॥ লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। ধরলার পানি বিপদ সীমার ১০৮ সেমি. এবং তিস্তার পানি বিপদ সীমার ৬৫ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজে রেড এ্যালার্ট জারি করেছে। প্রায় এক লাখ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বুড়িমারী-লালমনিরহাট-রংপুর-সান্তাহার-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নে পূর্ব বড়ুয়া গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ে আসার সময় ধরলা নদীর পানির তোড়ে ভেসে গিয়ে নাদিম (৫) ও আলিফ (৮) নামে দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। তারা দুজন খালাত ভাই। এ সময় তার বাবা-মাসহ তিনজন নিখোঁজ হন। রবিবার সন্ধ্যায় পূর্ব-বড়ুয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নওগাঁ ॥ কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে আত্রাই নদীর পানি হু-হু করে বাড়ছে। এ নদীর পানি এখন বিপদ সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। দুটি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে মান্দায় তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিন নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের অন্তত ৩০ পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে আত্রাই নদীর বাইবুল্যা এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ৫০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়ে। দুপুর ১২টার দিকে পার-নুরুল্লাবাদ উত্তরপাড়ায় আরেকটি বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে পানিবন্দী হয়ে পড়ে আড়াই শতাধিক পরিবার। বগুড়া ॥ বগুড়ায় যমুনা নদীতে পানি অস্বাভাবিক গতিতে বাড়ছে। রবিবার বিকেলে সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৫৩ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বৃদ্ধির ফলে সারিয়াকান্দি, ধুনট ও সোনাতলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। লোকজন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। নিম্নাঞ্চল ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করেছে। সিরাজগঞ্জ ॥ টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে ফের পানি বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার পানি বিপদসীমার ৬৩ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে কাজীপুর, বেলকুচি, চৌহালী, শাহজাদপুর ও সদর উপজেলার দুই শতাধিক গ্রাম পুনরায় বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। গাইবান্ধা ॥ গত চারদিনের টানা বর্ষণ এবং উজানের ঢলে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্রসহ প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। রবিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২৯ সেমি. এবং ঘাঘট নদীর পানি ৮ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুনামগঞ্জ ॥ ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লক্ষাধিক মানুষ। তলিয়ে গেছে পথ, ঘাট, ফসলি জমি। সাত উপজেলার প্রত্যেকটি গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা জেলা শহরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সকাল ১০টায় সুরমা নদীর ষোলঘর পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৮১ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রোপা আমনের ৬৬৫ হেক্টর বীজতলা পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়াও প্রায় চার হাজার হেক্টর রোপা আমনের ফসল তলিয়ে গেছে। ছয় উপজেলার বাজারগুলোর দোকানপাট তলিয়ে বাজার-হাট বন্ধ রয়েছে। রাঙ্গামাটি ॥ তিন দিনের ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে রাঙ্গামাটির ছয় উপজেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা আবারও ঝুঁকিতে পড়েছে। বাঘাইছড়ি পৌরসভাসহ বেশকিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। সেখানে ৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। একই সঙ্গে কাপ্তাই বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে ১৬টি স্পিল ওয়ে খুলে দিয়েছে। রাঙ্গামাটি চট্টগ্রাম সড়কের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের সৃষ্টি হয়েছে। জামালপুর ॥ দ্বিতীয় দফা বন্যায় রবিবার সকাল থেকে দেওয়ানগঞ্জ, ইসলামপুর, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ীতে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যার কারণে ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জের ১১ বিদ্যালয়ের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৪ সেমি. ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অধিকাংশ রাস্তাঘাট ডুবে গেছে। পার্বতীপুর ॥ টানা তিনদিনের ভারি বৃষ্টিপাতে পার্বতীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। শত শত বাড়িঘর ভেঙ্গে পড়েছে এবং তলিয়ে গেছে। ট্রেন চলাচল বিঘিœত হয়েছে।
×