ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সব পরিকল্পনাই ফাইলবন্দী

পাহাড়ধস ঠেকাতে কোন সুপারিশই আলোর মুখ দেখে না

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ১২ আগস্ট ২০১৭

পাহাড়ধস ঠেকাতে কোন সুপারিশই আলোর মুখ দেখে না

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ প্রতি বর্ষা মৌসুমেই অতিভারি বর্ষণে দেশের বিভিন্নস্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেই চলেছে। এতে একদিকে যেমন প্রাণহানি ঘটছে, অপরদিকে বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে নতুন নতুন বসতিও গড়ে উঠছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে পাহাড় ধসের ঘটনা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তবে এবারের মৌসুমে গোটা পার্বত্যাঞ্চল পাহাড় ধসে তছনছ হয়ে গেছে, যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়েছে। পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটলে প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। গঠন হয় কমিটি। আর এসব কমিটি তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনিক পর্যায়ে প্রণয়ন করে পাহাড় ধস রোধে দফার পর দফা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এসব দফা বাস্তবায়নের লেশমাত্র নেই। সর্বশেষ পাহাড় ধস বন্ধে পাহাড় ব্যবস্থাপনা নীতি প্রণয়নসহ ১২ দফা সুপারিশ পেশ করেছে পরিবেশ অধিদফতর। গত বৃহস্পতিবার এ সংক্রান্ত সুপারিশ ও প্রতিবেদন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়েছে। এর আগে গত ২০ জুন পাহাড় ধস বন্ধে পাহাড় কাটাসহ ২৫ দফা প্রস্তাব করা হয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ এ অঞ্চলের ভূমিধস পরিস্থিতি করণীয় নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় এসব দফা পেশ করা হয়, যেখানে ১৮টি মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আরও আগে ২০০৭ সালে চট্টগ্রামে ভয়াবহ পাহাড় ধসে রেকর্ডসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার দফতরের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি এর দীর্ঘ রিপোর্টে পাহাড় ধসের ২৮ কারণ চিহ্নিত করে ৩৬দফা সুপারিশ করেছিল। ওইসব সুপারিশে তাৎক্ষণিক, স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণের নানা কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এর একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে প্রতি বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় ধসছে পাহাড়, মরছে মানুষ। ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে সহায়সম্পদের। ঘটনা ঘটার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে যে তোড়জোর পরিলক্ষিত হয় এর গতি থমকে যায় বর্ষা মৌসুম শেষ হয়ে গেলে। এভাবেই চলছে পাহাড় ধস ঠেকাতে প্রশাসনিক কার্যক্রম, যা কেবলই জনগণের প্রতি উপহাস সমতুল্য। মূলত রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে পাহাড় ধ্বংসের যে অবৈধ তৎপরতা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তা কোন আমলেই রোধ করা যায়নি, যাচ্ছে না এবং আগামীতেও যাবে কিনা, প্রশ্নসাপেক্ষ। ফলে কখনও ৩৬ দফা, কখনও ২৫ দফা, সর্বশেষ ১২ দফা সুপারিশমালার বিপরীতে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। পক্ষান্তরে, পাহাড় ধসের যে কারণসমূহ বিভিন্ন কমিটি প্রণয়ন করছে তা বাস্তবায়নে ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারছে না প্রশাসনিক সংস্থাগুলো। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী মহানগরীর বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে লাখ লাখ মানুষের অবৈধ বসতি গড়ে উঠেছে। একই অবস্থা কক্সবাজার এবং পাহাড়ী তিন জেলায়ও। পাহাড় কাটা বন্ধে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে উন্নয়ন সংস্থা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত রয়েছে। কিন্তু কার কথা কে শোনে। পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রণয়নে পরিবেশ আদালতও সৃষ্টি করা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন বা আদালতের পক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণের কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয় না। তবে বিভিন্ন সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান চালিয়ে যে জেল-জরিমানা করা হয় তাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এ অবস্থায় পরিবেশ অধিদফতরের পক্ষ থেকে সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার পাহাড় কাটা ও ধস রোধে যে ১২ সুপারিশমালা পেশ করা হয়েছে তাতে নতুনত্ব কিছুই নেই। এসব সুপারিশ ২০০৭ সালে প্রণীত চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিটি ও গত জুনে ১৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধির সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সুপারিশমালা সংক্ষেপিত একটি রূপ হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছে। বছরের পর বছর যেখানে অবৈধপন্থায় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারেই পাহাড় কাটা ও এর মাটি পরিবহন চলে আসছে সেখানে দৃষ্টান্তমূলক কোন ব্যবস্থা নেই। এর ফলে বর্ষা মৌসুম এলেই কোন না কোন স্থানে পাহাড় ধসছে, প্রাণহানি ঘটছে। কারা পাহাড় কাটে, কেন কাটে, নেপথ্যে কোন প্রভাবশালীর জড়িত সবই প্রশাসনের জানা। অথচ, এ প্রভাবশালীর নেটওয়ার্কে যারা হাত দেয় তাদের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হয়ে যায়। ফলে দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা আত্মরক্ষার্থে নীরব ভূমিকায় চলে যান। এছাড়া গোপন পথের অবৈধ অর্থের লেনদেন তো রয়েছেই। আবার কাটার ক্ষেত্রেও ধাপ রয়েছে। ছোট বা বড় আকৃতির পাহাড় কাটার বিপরীতে লেনদেনের বিষয়টিও অনুরূপ। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পাহাড় কাটা বন্ধে বিভিন্ন সময়ে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়ে থাকে তা বাস্তবায়নের বিষয়টি যখন দৃশ্যমান হয় না তখন কেবলই জনমনে উৎকণ্ঠার পাশাপাশি হাস্যরসেরও সৃষ্টি করে। ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা রেকর্ড সৃষ্টি করে। এ ঘটনার পর চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার অফিসের পক্ষ থেকে গঠিত কমিটি যে ৩৬ দফা সুপারিশ পেশ করেছিল তার আংশিক বাস্তবায়ন করা গেলেও এ অবৈধ তৎপরতা অনেকাংশে রোধ হত বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। কিন্তু সত্য হচ্ছে, এসব সুপারিশ সবই ফাইলবন্দী। এরপর গত জুন এবং গত বৃহস্পতিবার পৃথক পৃথকভাবে পাহাড় কাটা ও ধস রোধে ২৫ ও ১২ দফা যে সুপারিশ প্রণীত হয়েছে তাও যে ফাইলবন্দী হয়ে হিমাগারে যাবে না তা নিয়ে ইতোমধ্যেই সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। দেশে বিশেষ করে বৃহত্তর চট্টগ্রামে পাহাড় ধসের ঘটনাটি যেহেতু নতুন নয় এবং প্রতি বর্ষা মৌসুমে কোথাও না কোথাও ধসের ঘটনা ঘটছে। এবারের মৌসুমেও ঘটেছে। বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চলের তিন ঘটনায় ঘটেছে নজিরবিহীনভাবে। এরপরও পাহাড় সুরক্ষায় কমিটির পর কমিটি, সুপারিশের পর সুপারিশ প্রণীত হচ্ছে। কাজের কাজ বলতে সবই যেন কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকছে।
×