ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

‘যারা ঘরের আপনজন সেজে যাওয়া-আসা করল তারাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বেইমানি করেছে’ জাতীয় শোক দিবসের মাসব্যাপী কর্মসূচীর প্রথমদিন কৃষক লীগের রক্তদান কর্মসূচী ও আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী

জিয়া-মোশতাকই খুনী জড়িতজড়িত

প্রকাশিত: ০৫:০৫, ২ আগস্ট ২০১৭

জিয়া-মোশতাকই খুনী জড়িতজড়িত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত উল্লেখ করে বলেছেন, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যা করতে পারেনি, ঘরের আপনজন সেজে যারা আসা-যাওয়া করল তারাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বেইমানি করল। বঙ্গবন্ধুর এত কাছে থেকে স্নেহ-ভালবাসা পেয়ে কিভাবে তারা বেইমানি করল? পাকিস্তানী হানাদারদের দোসর, যারা নামে মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু হৃদয়ে পাকিস্তান ছিল- তারাই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশের চরম সর্বনাশ করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বেইমান-মোনাফেক খুনী মোশতাক জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেছিল। তাই খুনী মোশতাকের বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জিয়াও যে জড়িত ছিল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সারাটা জীবন দেশের মানুষকে শুধু দিয়েই গেছেন, শুধু একখ- রিলিফের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নিয়ে যাননি। ১৫ আগস্ট বাঙালী জাতির জীবনে একটি কালো অধ্যায়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন, জাতির জীবনে ১৫ আগস্ট না আসতÑ তবে স্বাধীনতার ১০ বছরের মধ্যেই সারাবিশ্বে বাংলাদেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত হতো, বাংলাদেশ হতো বিশ্বের কাছে একটি দৃষ্টান্ত। মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে, ভাগ্যের পরিবর্তন করতে বঙ্গবন্ধু জীবন দিয়ে আমাদের রক্তঋণে আবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে পারলেই বঙ্গবন্ধুর রক্তঋণ কিছুটা হলেও আমরা শোধ করতে পারব। জাতীয় শোক দিবসের মাসব্যাপী কর্মসূচীর সূচনা দিন মঙ্গলবার বিকেলে ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ কৃষক লীগ আয়োজিত রক্তদান কর্মসূচী ও আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। সংগঠনটির সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন- কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, মাহবুবুল আলম হানিফ, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এনামুল হক শামিম, ফরিদুন্নাহার লাইলী, স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নুর তাপস, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডাঃ কামরুল হাসান খান ও সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শামসুল হক রেজা। আলোচনা সভা শেষে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশে কৃষক লীগ আয়োজিত রক্তদান কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবন এবং তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যাকা-ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বার বার আবেগে জড়িয়ে পড়েন তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। বক্তব্য রাখতে গিয়ে বেশ কয়েকবারই আবেগে থেমে যান তিনি। বাইরে মুষলধারার বৃষ্টির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আবেগজড়িত সেই স্মৃতিচারণে উপস্থিত অনেক নেতাকর্মীও নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্মম হত্যাকা-ের পর বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে যাতে কেউ আসতে না পারে সে জন্য কারফিউ দেয়া হয়। কিন্তু তা উপেক্ষা করে সেখানে শোকার্ত মানুষ এসে জানাজায় অংশ নেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে তিনি বলেন, তিব্বত ৫৭০ সাবান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গোসল করানো হয়। কাফনের কাপড় ছিল না। বঙ্গবন্ধু দেশের দুঃখী মানুষের জন্য যে রিলিফের কাপড় এনেছিলেন, সেই রিলিফের একটি কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে তা পরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দাফন করা হয়। ওই একখ- রিলিফের কাপড় ছাড়া বঙ্গবন্ধু আর কিছুই নিয়ে যাননি। সারাটা জীবন এ দেশের মানুষের জন্য শুধু দিয়েই গেছেন। বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে হিসেবে তাঁর কাছ থেকে দেখা কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশের সর্বনাশ করল, তাদের অনেকেই আমাদের বাসায় যাতায়াত করত। খুনী ডালিমসহ তার শাশুড়ি, স্ত্রী, শালিকা দিনরাত পড়ে থাকত বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। খুনী মেজর নূর মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্নেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে শেখ কামালের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করেছে। আর খুনী মোশতাক তো আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রী ছিল। কর্নেল ফারুক বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটের অর্থমন্ত্রী মল্লিক সাহেবের আত্মীয় ছিল। মেজর জিয়াকে মেজর জেনারেল পর্যন্ত পদোন্নতি দিয়েছিলেন জাতির পিতাই। এমনকি তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে যে ঝামেলা হয়েছিল তারও সমাধান করে দেন বঙ্গবন্ধু। মাসে দু’তিন বার খালেদা জিয়াকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে আসত এই জিয়াউর রহমান। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুর বাসায় পড়ে থাকতেন, স্নেহ-ভালবাসা নিয়েছেন, তারা কীভাবে এত বড় বেইমানি করল? পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দিয়ে হত্যার অনেকবারই চেষ্টা করেছে। পাকিস্তানী শত্রুরা যেটা পারেনি, সেই কাজটা যারা দিনরাত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ঘোরাফেরা করত তারাই বেইমানি করল। তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট আমি বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়েছি, কিন্তু বাঙালী জাতি হারিয়েছে স্বাধীনতার স্বপ্ন, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সোনালি দিন, শেষ হয়ে যায় তাদের সম্ভাবনাময় আশা-ভরসা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে শুরু হয় হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। খুনীদের বিচার না করে ইনডেমনিটি দিয়ে বিদেশী দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করে জেনারেল জিয়া। মাত্র আড়াই মাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি খুনী মোশতাক। তাকে হটিয়ে রাষ্ট্রপতি সায়েমকে অস্ত্র ঠেকিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন করে একাধারে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ও সেনাপ্রধান ঘোষণা করেছিল জিয়া। বঙ্গবন্ধুর খুনীরা তখন দম্ভভরে বলেছিল তাদের কেউ বিচার করতে পারবে না। শুধু খুনীদের পুরস্কৃতই শুধু নয়, যুদ্ধাপরাধীদের কারাগার থেকে মুক্ত করে রাজনীতিতে পুনর্বাসন এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা বানিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করেছিল জেনারেল জিয়া। শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই রাজনৈতিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু রাষ্ট্রপতিসহ তাঁর পুরো পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার ঘটনা পৃথিবীর কোন দেশে হয়নি। ছোট শিশু রাসেল, সুকান্তি বাবুদেরও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা দুই বোন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের মাত্র ১৫ দিন আগে শেখ রেহানাকে নিয়ে আমি জার্মানিতে গিয়েছিলাম। ১৫ দিন পর শুনতে পারলাম আমাদের কেউ আর বেঁচে নেই। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী জিয়া শেখ রেহানার পাসপোর্টের মেয়াদ পর্যন্ত বাড়াতে দেয়নি। আমাদের ৬ বছর দেশে আসতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করেছিলেন, মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন- বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আওয়ামী লীগ তিনবার ক্ষমতায় আছে বলেই দেশের মানুষ তার শুভ ফল পাচ্ছে। দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে আমরা ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছি, এ কারণে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোলমডেল। সারাদেশে আয় বৈষম্য হ্রাস পেয়েছে। মানুষ একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখছে। আমরা যদি মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারি, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়তে পারি, প্রতিটি মানুষের জীবনে অর্থবহ উন্নয়ন করতে পারি- তাহলে বঙ্গবন্ধুর আত্মার শান্তি পাবে, কিছুটা হলেও তাঁর রক্তঋণ আমরা শোধ করতে পারব। এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাওয়ার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ইনশাআল্লাহ এ দেশ হবে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।
×