ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

ময়মনসিংহে মাদকের থাবা-শেষ

মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ফ্রি স্টাইলে মাদক সেবন, নির্যাতন

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১ আগস্ট ২০১৭

মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ফ্রি স্টাইলে  মাদক সেবন, নির্যাতন

বাবুল হোসেন, ময়মনসিংহ ॥ শহরে মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে প্রায় অর্ধশত! এ সংখ্যা থেকেই অনুমান করা যায় শহরে মাদকের ভয়াবহতা কতটুকু। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র দ্বীপের পরিচালক সুমনের দাবি, মাদকাসক্তদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে সুস্থ করে তুলতেই এসব কেন্দ্রের উদ্ভব। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোন অনুমোদন ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে এসব কেন্দ্র। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগের দেয়া তথ্যমতে শহর ও শহরতলিতে এ রকম নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা মাত্র ১৫টি। এর মধ্যে শহরের মাসকান্দা ২৭ নম্বর আমিরাবাদ এলাকার ‘দীপ’, কাঠগোলা ঢোলাদিয়া এলাকার ‘ঠিকানা’, ১৩ নম্বর বলাশপুর ঠিকানায় ‘প্রভাত ফেরিসহ সেতু, প্রাপ্তি, সাকু, আইডিয়া, পারপার, স্বপ্ন ও আলোকিত জীবন নামের ১০টি নিরাময় কেন্দ্রের অনুমোদন রয়েছে। আর বেসরকারী হিসেবে এ কেন্দ্রের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। এদের মধ্যে মাসকান্দার গনশার মোড় এলাকার ‘স্বাদ’ মাসকান্দা আমিরাবাদ এলাকায় ‘ডিএমডিসি’, কাচিঝুলি ইটাখলা রোডের পূর্ণজীবন ও বাঘমারা এলাকায় ‘আলো’ মাদকসক্তি নিরাময় কেন্দ্রসহ অনেক কেন্দ্রের কোন অনুমোদন নেই বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। অুনমোদনবিহীন এসব কেন্দ্রে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে ভেতরে মাদক সেবনের প্রতিযোগিতা চলে বলে প্রচার রয়েছে। এসব কেন্দ্রের ভেতর থেকে সারাক্ষণ তালা লাগিয়ে রাখায় সরেজমিনে গিয়েও কোন মালিকের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। শহরের বাঘমারা এলাকার একটি নিরাময় কেন্দ্রের মালিকের সঙ্গে সাংবাদিক পরিচয়ে কথা বলতে চাইলে, ফোন কেটে দেন বারবার। মূলত এক সময়কার মাদকসেবেিদর অনেকে এসব কেন্দ্রের পরিচালক কিংবা কর্ণধার। এককালীন মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে সুস্থ করে তোলার আশ্বাস দিয়ে মাদকাসক্তদের কেন্দ্রে নেয়ার পর তাদের নিয়মিত মাদক সরবরাহ করা হয়। অবাধ্যদের শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। শহরের দীঘারকান্দা ও মাসকান্দার আলাদা দুইটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে নির্যাতন চালিয়ে দুজনকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। পরে অবশ্য সবকিছুই ধামাচাপা দেয়া হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, ময়মনসিংহ উপ-অঞ্চলের স্থানীয় কর্মকর্তারা বলছেন, ইতোমধ্যে সেতু নামের একটি নিরাময় কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অনুমোদনবিহীন অন্য কেন্দ্র বন্ধে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। মাদকবিরোধী সমাবেশ মাদকের কড়াল গ্রাস থেকে নতুন প্রজন্মকে রক্ষাসহ গণসচেতনতা বাড়াতে স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শহর ও গ্রামে চলছে মাদকবিরোধী সভা সমাবেশ। মাদকবিরোধী চলমান সমাবেশের অংশ হিসেবে রবিবার ময়মনসিংহের টাউনহলের এ্যাডভোকেট তারেক স্মৃতি মিলনায়তনে মাদকবিরোধী বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাবেশের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে উজজীবিত করতে রবিবারের সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি, ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ এমপি, এ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহমেদ এমপি ও সালাহ উদ্দিন আহমদ এমপিসহ মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এমপি হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, মাদক ব্যবসায়ী যত প্রভাবশালী হোক না কেন কাউকে ছাড় দেয়া হবে। ধর্মমন্ত্রী আলহাজ অধ্যক্ষ মতিউর রহমান মাদক ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ এমপি বলেছেন কেবল মাদক উদ্ধার নয়, কোথা থেকে মাদক আসছে সেই রুট চিহ্নিতসহ মাদক ব্যবসায়ীদেরও আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহমেদ এমপি বলেছেন, মাদকের কড়াল গ্রাম থেকে সন্তানদের রক্ষায় অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। সালাহ উদ্দিন আহমেদ এমপি বলেছেন, মাদক ব্যবসায়ীদের কোন দল নেই। ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম বলেছেন, মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রেফতারের পর আইনের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে আদালত থেকে জামিন বের হয়ে আসছে। মাদক ব্যবসায়ীদের পক্ষে কোন আইনজীবীকে সহায়তা না দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। সমাবেশে অন্য বক্তারাও মাদক ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে পুলিশের জিরো টলারেন্স অবস্থান নেয়ার দাবি জানান। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার পর্যবেক্ষণ স্থানীয় একটি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা-এনজিওর জরিপে দেশে মাদক সেবন ও ব্যবসায় শীর্ষস্থানীয় ১০ জেলায় মনমনসিংহের অবস্থান টপটেন এ। গত এক দশক আগে ইনজেকটিভ মাদক গ্রহণে ময়মনসিংহের অবস্থান ছিল এক নম্বরে। মাদকাসক্তদের নিয়ে কাজ করা এ সংস্থার হিসাব মতে গত ২০১৪ সালে শহরে নিয়মিত ইনজেকটিভ মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল এক হাজার। তবে ইয়াবা ও ফেনসিডিলের ক্রাইসিস হলে এর সংখ্যা ৩ হাজার ছাড়িয়ে যেত বলে দাবি সংস্থাটির নিবার্হী পরিচালক ও এডাব সভাপতি খন্দকার ফারুক আহমদের। সংস্থাটির পরিচালক আরও জানান, ময়মনসিংহে মাদকের ব্যবহার ও ব্যবসার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন ও উদ্বেগজনক। মামলার রেকর্ড মাদক নিয়ে কাজ করছে ময়মনসিংহ পুলিশসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিভাগ, বিজিবি, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও এলিটফোর্স র‌্যাব। এসব সংস্থার দেয়া তথ্যমতে চলতি সালের গত এক বছরে মাদকদ্রব্য আইনে ময়মনসিংহ বিভাগে মামলা হয়েছে ৬০৯০টি। এসব মামলায় ৬ হাজার ৫৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ময়মনসিংহ আদালতে কয়েক হাজার মাদকের মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অধিকাংশ মামলার আসামিরা আদালত থেকে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে বলে দাবি মাদক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাদের। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, ময়মনসিংহ উপ-অঞ্চলের উপ-পরিচালক আলী আসলাম হোসেন জানান, গত এক বছরে ৬৯৪টি মামলার বিপরীতে ৪৩২ জন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু এসব মামলায় ধরা পরার পর প্রভাবশালী আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আবার মাদকের ব্যবসা করছে। পুলিশ সুপার যা বলেনÑ ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম বিপিএম, পিপিএমের মতে, চুরি ছিনতাই ডাকাতিসহ সকল অপরাধের মূল কারণ হচ্ছেÑ এ মাদক। ময়মনসিংহের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী খোকন পুলিশ ক্রসফায়ারে নিহত ও আরেক ব্যবসায়ী আলালসহ অনেকে দীর্ঘদিন জেলহাজতে থাকায় এখন শহরের পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে বলে দাবি এ পুলিশ কর্মকর্তার। মাদকের ব্যাপারে ময়মনসিংহ পুলিশ জিরো টলারেন্স দেখাবে বলেও জানান এ কর্মকর্তা। তবে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের সচেতনতার কোন বিকল্প নেই উল্লেখ করে এ পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, এলাকার জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ময়মনসিংহ পুলিশ গণসচেতনতা বাড়াতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও শহর ও গ্রামে মাদকবিরোধী সভা সমাবেশ করছে। এছাড়া মাদকাসক্তদের পুর্নবাসনেও কাজ করছে ময়মনসিংহ পুলিশ। এরই অংশ হিসেবে গত রবিবার বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের উপস্থিতিতে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ৩৫ জন মাদকাসক্ত এর মধ্যে ২৫ জনকে রিক্সা ও ১০ জন সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়।
×