ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রেফতারকৃত ম্যানেজারসহ ৫ জনের জামিন নামঞ্জুর ॥ নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ

হালিশহর সিএসডি থেকে অতীতেও টনে টনে চাল খোলা বাজারে চলে গেছে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২১ জুলাই ২০১৭

হালিশহর সিএসডি থেকে অতীতেও টনে টনে চাল খোলা বাজারে চলে গেছে

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে সরকারী খাদ্য গুদাম থেকে চাল পাচার হয়ে র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ার ঘটনার পর বিভাগের অধীনে গুদাম কর্মকর্তাদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। নগরীতে হালিশহর ও দেওয়ানহাট সিএসডি (সেন্ট্রাল স্টোরেজ ডিপো) কে কেন্দ্র করে র‌্যাবের নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। শীঘ্রই পাহাড়তলী সাগরিকা এলাকার চাল মজুদের বেসরকারী ওয়্যারহাউসগুলোতে অভিযান চালানোর চিন্তা ভাবনা চলছে। এদিকে গ্রেফতারকৃত হালিশহর সিএসডির ম্যানেজারসহ ৫ জনের জামিন আবেদন বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম আদালতে নামঞ্জুর হয়েছে। হালিশহর সিএসডির অভিযুক্ত ম্যানেজার প্রণয়ন চাকমা গ্রেফতার হওয়ায় উক্ত সিএসডিতে নতুন ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যিনি নিয়োগ পেয়েছেন তিনি হলেন কুমিল্লার ধর্মপুরের এলএসডি ম্যানেজার আনোয়ার হোসেন। অপরদিকে, হালিশহর সিএসডি থেকে পাচার হওয়া চালের ঘটনা নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য বিভাগীয় দফতর সূত্রে জানা গেছে, চাল পাচারের ঘটনা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের উর্ধতন মহল ব্যাপকভাবে তৎপর হয়েছে। পুরো বিভাগে খাদ্যের মজুদ পরিস্থিতি নতুন করে সরেজমিনে তদন্ত করে দেখা হবে। গত মঙ্গলবার হালিশহর সিএসডি থেকে পাচার হওয়া চাল দু’দফায় উদ্ধার করা হয়েছে। প্রথম দিন ৭ ট্রাক ও পরদিন অর্থাৎ বুধবার ১ ট্রাক উদ্ধার হয়েছে। এখনও আরও ২ ট্রাক চালের কোন খবর নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। কারণ, যেসব স্থানে এসব চাল আটক করা হয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ট্রাকের সংখ্যা ছিল ১০টি। এ পর্যন্ত র‌্যাব ৮ ট্রাক উদ্ধার করে পুনরায় সিএসডি গোডাউনে পৌঁছে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানানো হয়েছে, হালিশহর সিএসডির অতীত ইতিহাস অত্যন্ত খারাপ। কেননা, এ সিএসডি থেকে অতীতেও টনে টনে চাল খোলাবাজারে চলে গেছে। অথচ, চালের পরিমাণ সব সময় কাগজে কলমে ঠিক দেখানো হয়েছে। যেসব স্থানে এসব চাল পৌঁছানোর কথা সেখানকার গুদামগুলোর রেকর্ডেও কাগজপত্রে ঠিকঠাক রয়েছে। সরকারী বিভিন্ন কর্মসূচীর আওতায় বিপুল পরিমাণ চাল লোপাট হয়ে গেছে। এতে সরকারের ক্ষতি বড় অঙ্কের অর্থের। এসব ঘটনা নিয়ে গুদাম কর্মকর্তাদের রদবদল করা হয়েছে। কাউকে ওএসডি, কাউকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে সবই ঠিকঠাক হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি অনিয়মের অভিযোগ ভুরি ভুরি। কিন্তু রদবদল বা বদলি বা ওএসডি ছাড়া আর কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি গ্রহণের তেমন নজির নেই। সরকারের খাদ্য মজুদের দেশব্যাপী যে ১৩টি সিএসডি রয়েছে তন্মধ্যে চট্টগ্রামের হালিশহর ও দেওয়ানহাটের গুদাম দুটি অন্যতম বৃহৎ। পাশাপাশি হালিশহর সিএসডি দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ। এসব গুদামে পোস্টিং নিয়ে ম্যানেজাররা জড়িত হয়ে যায় দুর্নীতির আষ্টেপৃষ্ঠে। সরকারী চাল গোপন পথে চলে যায় খোলাবাজারে। বিশেষ করে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী সাগরিকা চালের বাজারের সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা এসব চালের মূল ক্রেতা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারী চালের বস্তায় যে সীল থাকে অনুরূপ সীল সংবলিত বস্তায় এ চাল সাধারণ মানুষ কিনে থাকে। সূত্র আরও জানায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশে আগামীতে খাদ্য সঙ্কট হতে পারে এ আশঙ্কায় সরকার আগেভাগেই বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি শুরু করেছে। চালের দুটি চালান ভিয়েতনাম থেকে এসে খালাস প্রক্রিয়াও চলছে। যদিও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মঙ্গল ও বুধবার তা ব্যাহত হয়েছে। এসব চাল হালিশহর সিএসডিতেই মজুদ করা হবে। পাশাপাশি কর্মসূচী অনুযায়ী অন্যান্য গুদামেও রাখা হবে। এ অবস্থায় দুর্যোগের কারণে সরকারী মজুদের এ চাল বিক্রি করার দুঃসাহসিক তৎপরতা যারা চালাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হয়ে দৃষ্টান্তমূলক হওয়াই বাঞ্ছনীয় বলে বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়েছে। সরকারী এসব চাল মজুদ ও সরবরাহ অর্থাৎ চলাচল প্রক্রিয়ায় যে বড় একটি চেইন রয়েছে এবং এ চেইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তাদের তদন্তের আওতায় আনা গেলে আরও বড় ধরনের রহস্য বেরিয়ে আসবে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। কেননা, চট্টগ্রামের এ দুটি সিএসডি থেকে অহরহ চাল পাচার হয়ে যাবার ঘটনা রয়েছে। এর সঙ্গে গুদাম কর্মকর্তারা যেমনি জড়িত, তেমনি জেলা ও আঞ্চলিক বিভাগীয় খাদ্য অফিসের কর্মকর্তারাও সংশ্লিষ্ট থাকার অভিযোগ আছে। এর পাশাপাশি সিভিল প্রশাসনের যে তদারকি তৎপরতা রয়েছে সেক্ষেত্রেও দুর্বলতা বা যোগসূত্র থাকার অবকাশ রয়ে যায়। সুষ্ঠু তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে থলের বিড়াল। এ জাতীয় দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের এখনই সময়। কেননা, সময় যতই গড়িয়ে যাবে ততই গুদাম পরিস্থিতি ভিন্নভাবে আবির্ভূত হবে। হালিশহর সিএসডির অতীত ইতিহাস এমন যে, সরকারের বিপুল অঙ্কের অর্থে আমদানিকৃত চাল টনে টনে পাচার হয়েছে অবাধে। মজুদের সঙ্গে সরবরাহের মিল নেই। আবার সরবরাহের তালিকার সঙ্গে মজুদের মিল নেই। এ অবস্থা চলছে বছরের পর বছর ধরে। চাল পরিবহনের সঙ্গে জড়িত পরিবহন ঠিকাদারদের বড় একটি গ্রুপ চাল পাচারের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। আর পাচারের চাল ক্রয়ের জন্য রয়েছে অসাধু ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের একটি সিন্ডিকেট। এরা কখনও একক, আবার কখনও যৌথভাবে পাচারের চাল ক্রয় করে হজম করে ফেলে। পরবর্তীতে তা খোলাবাজারে ছেড়ে দেয়। এমন ঘটনা রয়েছে, এ জাতীয় চাল বেসরকারী ওয়্যারহাউসগুলোতে মজুদ রেখে চালের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেয়। এভাবে সরকারের ভাবমূর্তি একদিকে যেমন বিনষ্ট হচ্ছে, তেমনি অপরদিকে সাধারণ মানুষ বাড়তি মূল্যে চাল কিনতে বাধ্য হয়। অথচ, ওপেন সিক্রেট এ বিষয়টি শক্ত হাতে নজরদারিতে আনার বিষয়টি বরাবরই অনুপস্থিত থেকে যায়। র‌্যাব সেভেন সূত্রে জানানো হয়েছে, নানা সময়ে তারা এসব সিএসডি থেকে চাল পাচার হয়ে যাওয়ার অভিযোগ পেয়ে থাকে। কিন্তু চাল পাচারের সঙ্গে জড়িত একাধিক চক্র দুর্নীতি এমনভাবে করে থাকে যা সহজে নজরে আনা যায় না। কাগজপত্র ঠিকঠাক রেখে চাল যখন ডেলিভারি হয় তখন ধরার কোন সুযোগ থাকে না। এমনি অবস্থায় গোপন সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে গত মঙ্গলবার অভিযানে প্রথমে ৭ ট্রাক ও বুধবার আরও ১ ট্রাক চাল উদ্ধার হয়। আরও যে চাল বোঝাই দুইটি ট্রাক উধাও হওয়ার খবর রয়েছে তা উদ্ধারেও নজরদারি রয়েছে। দুই সিএসডি ও পাচার হওয়ার রুটগুলোতে র‌্যাব সদস্যদের নজরদারি বলবৎ রয়েছে। বৃহস্পতিবার র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এখন পর্যন্ত আরও দুই ট্রাক চাল পাচার হয়ে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য তাদের কাছে আসেনি। কিন্তু মঙ্গলবার র‌্যাব যে দুটি স্থান থেকে ৮ ট্রাক চাল আটক করেছে ওই সময় চাল বোঝাই ট্রাকের সংখ্যা ছিল ১০। কিন্তু র‌্যাব ওইদিন আটক করেছে ৭ ট্রাক চাল। পরদিন বুধবার সাগরিকা সিটিগেট এলাকায় চাল বোঝাই আরও এক ট্রাক আটক হয়। র‌্যাব বলেছে, আটকের সময় ট্রাকচালক পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এসব ঘটনা নিয়ে খাদ্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলে নানা সন্দেহের উদ্রেক করেছে। খাদ্য বিভাগের বিভাগীয় পর্যায় থেকে উপজেলা পর্যন্ত চাল পাচারের যে চেইন তা দীর্ঘদিন আগে থেকে সৃষ্ট। এভাবেই সরকারী অর্থে কেনা চাল লোপাট হয়ে যায়। দুর্নীতিবাজরা অবৈধ পথে হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের অর্থ। শুধু তাই নয়, কর্মকর্তাদের প্রতিটি পয়েন্টে অর্থের ভাগ পৌঁছে দেয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
×