ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ব্যাংক সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করার পর উল্টো রিট

লাইসেন্স ছাড়াই আজিজ কো-অপারেটিভের অবৈধ ব্যাংকিং

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১৭ জুলাই ২০১৭

লাইসেন্স ছাড়াই আজিজ কো-অপারেটিভের অবৈধ ব্যাংকিং

রহিম শেখ ॥ আমানতে সুদ ১৮ শতাংশ! ঋণ বিতরণে সুদ আরও বেশি। একটির বেশি শাখা খোলার অনুমতি না থাকলেও সারাদেশে আছে ৯৭ শাখা। এসব শাখার মাধ্যমে হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতিদিন আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রম চালাচ্ছে সমবায় অধিদফতরের অধীনে পরিচালিত আজিজ কো-অপারেটিভ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই সব শাখার সাইনবোর্ডে সাবেক ‘এসিসিএফ ব্যাংক’ লিমিটেড শব্দটি জুড়ে দেয়া আছে। এছাড়া সমবায় সমিতি আইনের তোয়াক্কা না করেই নামের শেষে যুক্ত করা হয়েছে ‘কমার্স এ্যান্ড ফাইন্যান্স’ শব্দ। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটিতে সঞ্চয়ের সুরক্ষা না থাকায় গত মার্চে সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর অবৈধ ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম বন্ধ তো দূরের কথা উল্টো বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরুদ্ধেই আদালতে একটি রিট করে আজিজ কো-অপারেটিভ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থমন্ত্রী বরাবর চিঠি দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তবে তাদের এ ধরনের আচরণে ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন। জানা গেছে, বিদ্যমান ব্যাংক কোম্পানি আইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া ‘ব্যাংক’ শব্দটি ব্যবহারের সুযোগ নেই। সমবায় সমিতির সংশোধিত আইনেও ব্যাংক শব্দ ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সংশোধিত সমবায় সমিতি আইন ৯-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত বা নিবন্ধনের জন্য প্রস্তাবিত কোন সমবায় সমিতির নামের সঙ্গে কমার্স, ব্যাংক, ইনভেস্টমেন্ট, লিজিং, ফাইন্যান্সিং প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার করা যাবে না। ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা, চেক ইস্যু ও আন্তঃশাখা লেনদেন করতে পারবে না। একটির বেশি শাখা থাকবে না। তবে কোন সমবায় সমিতি তাদের নামে ব্যাংক শব্দ নিয়ে নিবন্ধিত হয়ে থাকলে তা ৩ মাসের মধ্যে সংশোধন করে নিবন্ধককে অবহিত করতে হবে। এ আইনের বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৭ বছরের কারাদ- বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত হবে। আইনে বলা হলেও সেটি মানা হচ্ছে না। আজিজ কো-অপারেটিভের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে এর সত্যতা মিলেছে। প্রতিষ্ঠানটির নামের নিচেই ইংরেজিতে বড় অক্ষরে সাবেক এসিসিএফ ব্যাংক লিমিটেড লেখা আছে। সব শাখা অফিসেই এ নামটি ব্যবহার হচ্ছে। তাছাড়া কমার্স ও ফাইন্যান্স শব্দটি প্রতিষ্ঠানটির নামের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সদস্যদের বাইরে সাধারণ মানুষ থেকে (অবৈধ ব্যাংকিং) আমানত সংগ্রহ করছে। দিচ্ছে বড় অঙ্কের ঋণ। গ্রাহক সেজে প্রতিষ্ঠানটির মতিঝিল, দিলকুশা, কাওরানবাজার, বাংলামোটর, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর শাখায় গেলে দেখা যায়, বড় বড় করে দেয়ালে ১৭টি ডিপোজিট প্রডাক্টের বিবরণ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মুদারাবা মাসিক মুনাফাভিত্তিক মেয়াদি আমানত হিসাব প্রকল্পটি সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি/যাদের কাছে অলস টাকা আছে, তারাই এ জাতীয় হিসাব খোলায় আগ্রহী হয়ে থাকে। ১ বছর, ৩ বছর, ৫ বছর ও ৮ বছর মেয়াদি যে কোন পরিমাণ টাকা আমানত হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যার মুনাফা মাসিক ভিত্তিতে প্রদান করা হয়ে থাকে। এ প্রকল্পে আকর্ষণীয় মুনাফা দেয়া হয়। তবে বার্ষিক মুনাফার হারে হ্রাস-বৃদ্ধি হতে পারে বলে জানালেন কর্মকর্তারা। মুদারাবা দৈনিক সঞ্চয় ও মাসিক সঞ্চয় নামে দুইটি প্রকল্পের আওতায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও প্রান্তিক পর্যায়ের খেটে খাওয়া মানুষ দৈনিক ও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে অর্থ জমা করেন। মতিঝিল শাখার ব্যবস্থাপক নুরুল আনোয়ার জানালেন, মুদারাবা ডাইরেক্ট ডেপোজিট স্কিমে ১৫ শতাংশ ও মুদারাবা ডাবল বেনিফিট স্কিমে সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ মুনাফা দেয়া হয়। আমানত সংগ্রহের পাশাপাশি সদস্যদের মধ্যে ঋণদান কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রতিষ্ঠানটি। সূত্র জানায়, সমবায় অধিদফতরের অধীনে পরিচালিত আজিজ কো-অপারেটিভের ব্যাংকিং করার কোন লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারপরও হাজার হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণের মতো অবৈধ কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। বেআইনীভাবে দেশজুড়ে খুলেছে ৯৭ শাখা। প্রতিষ্ঠানটির এসব কার্যক্রম অবৈধ আখ্যা দিয়ে ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক জনসাধারণকে সতর্ক করে নিজস্ব ফেসবুক পেজে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এরপর বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমেও বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, আজিজ কো-অপারেটিভ নামের প্রতিষ্ঠানটি বিনা অনুমোদনে সারা দেশে শতাধিক শাখা খুলে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং অতিরিক্ত মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে জনগণের কাছ থেকে চলতি, সঞ্চয়ী এবং বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী আমানত সংগ্রহ করছে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ সুদ হারে ঋণ প্রদান করছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আজিজ কো-অপারেটিভের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বলেন, কো-অপারেটিভগুলো পরিচালিত হয় সমবায় আইন অনুযায়ী। ফলে ব্যাংক কোম্পানি আইনে কি আছে সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে গণবিজ্ঞপ্তি দেয়ার পর আদালতে একটি রিট করা হয়। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে আর কোন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। এদিকে গত এপ্রিলে আজিজ কো-অপারেটিভের পক্ষ থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে একটি চিঠি পাঠানো হয়। আজিজ কো-অপারেটিভ কমার্স এ্যান্ড ফাইন্যান্স ক্রেডিট সোসাইটির বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও অন্য গণমাধ্যমে অসত্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সমিতির সুনাম নষ্ট, ভাবমূর্তি ক্ষুণœ, আর্থিক ক্ষতিসহ সমিতির স্বার্থহানিকর তৎপরতা বন্ধের আবেদন জানানো হয় চিঠিতে। তবে তাদের এ ধরনের আচরণে ক্ষুব্ধ অর্থমন্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধে কঠোর অবস্থানে যাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধের বিষয়ে ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত চেয়ে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, আজিজ কো-অপারেটিভের বিরুদ্ধে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগকে এর আগে অনুরোধ জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক পুলিশ অধিদফতরকে অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয় এবং প্রতিষ্ঠানটি সমবায় দফতর কর্তৃক নিবন্ধিত কিনা এবং নিবন্ধিত হয়ে থাকলে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক অবহিত করার জন্য সমবায় অধিদফতরকে অনুরোধ জানানো হয়। চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, অবৈধ ব্যাংকিং করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আজিজ কো-অপারেটিভের বিরুদ্ধে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সেটি স্বীকার করা তো দূরের কথা, উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গণবিজ্ঞপ্তির এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধরনের পদক্ষেপকে অপতৎপরতার সঙ্গে তুলনা করছে। অর্থমন্ত্রীর কাছে প্রতিষ্ঠানটির পাঠানো চিঠির বিষয়বস্তুতে সেটি আরও স্পষ্ট হয়েছে। তাই তাদের কার্যক্রম বন্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারাও অস্বস্তিতে আছেন। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান উচ্চ আদালতে রিট করে সমবায় অধিদফতরের সিদ্ধান্তের কার্যকরিতা স্থগিত করছে। অনেক ক্ষেত্রে লোকবল সঙ্কটের কারণে তারা ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
×