ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা এখনও নির্যাতনের শিকার

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ১১ জুলাই ২০১৭

মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা এখনও নির্যাতনের শিকার

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ন্যূনতম মানবাধিকার এখনও ফিরে আসেনি, বরং নানামুখী নির্যাতন এখনও অব্যাহত রয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের উপর। এছাড়া সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমার সরকারের ইতিবাচক কোন উদ্যোগ লক্ষ্যণীয় না হওয়ায় এ সমস্যা জটিল পর্যায়ে উপনীত হচ্ছে। জাতিসংঘসহ শক্তিধর বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে দফায় দফায় রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন বন্ধ এবং তাদের নাগরিকত্ব প্রদানসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হলেও মিয়ানমার সরকার এ নিয়ে কোন কর্ণপাত করছে না। শুধু তাই নয়, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিদের রাখাইন প্রদেশ সফরে কড়াকড়ি ব্যবস্থা আরোপ রয়েছে।গেল বছর থেকে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন ভয়াবহ পরিস্থিতি রূপ নেয়ায় দলে দলে এদের বড় একটি অংশ বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারও মানবিক বিবেচনা করে এদের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করছে না। কিন্তু বিষয়টি আগামীতে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেও সরকার পক্ষে ইতিমধ্যে আভাস দেয়া হয়েছে। এমন এক পরিবেশে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ গ্র্যান্ডি সোমবার কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন এবং এসব নিয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার যে নেই তা নিশ্চিত। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেন। দুপুরে তিনি ক্যাম্পে পৌঁছে একটি কমিউনিটি সেন্টারে সংশ্লিষ্ট রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলিত হন। এ সময় কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোঃ ইমরান ও টেকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের নেতা মোঃ জুবায়েরসহ যুব ও ছাত্র প্রতিনিধিরা তাদের সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের কাছে মিয়ানমার সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন এবং এ নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা করেন। বৈঠকে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (ভারপ্রাপ্ত) উপ-সচিব ফজলুল করিম চৌধুরীসহ ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত রবিবার সন্ধ্যায় সফররত জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার জাতীয় সংসদ ভবন কার্যালয়ে সাক্ষাত করেন। এ সময় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে চাপ দেয়ার জন্য ইউএনএইচসিআরসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার শরণার্থী সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সহায়তার আশ্বাস দেয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারের বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয়দানের মাধ্যমে ত্যাগ স্বীকারের জন্য ফিলিপ গ্র্যান্ডি বাংলাদেশের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন বলে সরকারী সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে। এ বিষয়টির ব্যাপারে টেকনাফ নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মোঃ জুবায়েরও জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। সোমবার জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ গ্র্যান্ডি কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শন করতে গেলে রোহিঙ্গারা তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে মানববন্ধন করে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গাদের দাবিগুলো মনোযোগ সহকারে শুনেন। অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি ও বৈধ শরণার্থী ক্যাম্প থেকে আল ইয়াকিন জঙ্গীরা এক মাসের মধ্যে তিন রোহিঙ্গাকে তুলে নিয়ে খুন করার ঘটনা নিহতদের স্বজনরা জানাতে আগ্রহী হলেও কতিপয় রোহিঙ্গা নেতা তা জানাতে দেয়নি বলে জানা গেছে। গত ১৩ জুন কুতুপালং ক্যাম্প থেকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে বালুখালী বস্তিতে অবস্থানকারী আল ইয়াকিন সদস্যরা তিন রোহিঙ্গা নেতাকে জবাই করে হত্যা করেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কুতুপালং এলাকার মেম্বার ও আওয়ামী লীগ নেতা বক্তেয়ার আহমদ জানান, বালুখালী এবং কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে দেশী, বিদেশী বিতর্কিত লোক, মিয়ানমারের বিদ্রোহী গ্রুপের ক্যাডার অবাধ বিচরণ করে থাকে। এতে নানা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী গ্রুপের অপতৎপরতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বালুখালী ও কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তিতে রোহিঙ্গার ছদ্মবেশে অবস্থানকারী আল ইয়াকিন ক্যাডাররা প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারা উন্নত এ্যাপস ব্যবহার করে প্রতিদিনের খবর ও চিত্র তৎক্ষণাৎ মিয়ানমারে অবস্থানরত জঙ্গীদের কাছে পৌঁছাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। গেল ১৩ জুন রাতে আল ইয়াকিনের ১০ থেকে ১৫ জনের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পে হানা দিয়ে দু’জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এরা হচ্ছে আইয়ুব মাঝি ও মোঃ সেলিম। পরে ১৮ জুন দুপুরে বালুখালী তেলীপাড়া খাল থেকে ভাসমান হাত পা বাঁধা ও গলাকাটা অবস্থায় মোঃ সেলিম এবং গত রবিবার রাতে অপহৃত মোঃ আয়ুব মাঝির লাশ একই অবস্থায় উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ। একইভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গত ২৩ মে কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের মালয়েশিয়া ফেরত মৃত ইমাম হোসেনের পুত্র মোঃ শফি প্রকাশ বলিকে রাতের অন্ধকারে ক্যাম্প থেকে অপহরণ করে জঙ্গলে নিয়ে খুন করে। ২৫ মে ক্যাম্পের অদূরে মধুরছড়া জঙ্গল থেকে মোঃ শফির প্রকাশ বলির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এক মাসের ব্যবধানে ৩টি চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- নিয়ে ক্যাম্প এলাকাসহ পুরো উখিয়ায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। মিয়ানমার অভ্যন্তরে আল ইয়াকিন ঘাঁটিতে অস্ত্র- বোমা সরবরাহসহ প্রতিমাসে মোটা অঙ্কের টাকা (চাঁদা) পাঠাতে একটি গ্রুপ গোপনে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে নিয়ে আসা বিদেশী অর্থ ছাড়াও সশস্ত্র ক্যাডাররা রোহিঙ্গা বস্তির প্রতি পরিবার থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করছে। এসবের নেতৃত্বে রয়েছে অস্ত্রের প্রশিক্ষক রোহিঙ্গা মাস্টার আয়ুব ও ভয়ঙ্কর জঙ্গী কক্সবাজারের রোমালিয়ারছড়া চৌধুরীপাড়ায় বসবাসরত মৌলবি শফিকুর রহমান। কিছুদিন আগে আল ইয়াকিনের এ ভয়ঙ্কর জঙ্গী শফিককে গোয়েন্দা সংস্থা ধরে কক্সবাজার সদর পুলিশে সোপর্দ করেছিল। কিন্তু তার সহযোগীদের ব্যাপক তদবির, অঢেল অর্থ ব্যয় ও পুলিশের দুর্বল রিপোর্টের কারণে বেশি দিন কারাগারে থাকতে হয়নি তাকে। জামিনে মুক্ত হয়ে আবারও গা ঢাকা দিয়ে গোপনে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। এসব ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ উৎকন্ঠায় রয়েছে নিরীহ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যরা। উখিয়ার কুতুপালং অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা বস্তি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক মোঃ নুর জানান, অপহরণকারী ও খুনীদের মধ্যে বালুখালী বস্তির রোহিঙ্গা কলিম উল্লাহ, ইসমাইল, ছলিম উল্লাহ, মোঃ কালু, মোঃ ইসলাম, কুতুপালং বস্তির সন্ত্রাসী মোঃ জাবের, মোহাম্মদ নুর, মনির আহামদ, খুইল্যা মিয়া মুন্না, সেলিম, কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের সশস্ত্র একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের নিকট থেকে অপরণপূর্বক চাঁদা দাবি, খুন, ঘুমসহ বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। আবু ছিদ্দিক আরও জানান, গত ঈদের পরের দিন কোন কারণ ছাড়াই সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে গুরুতর জখম করে তাকে। কয়েকদিন চিকিৎসা শেষে বস্তিতে ফিরেছেন। তিনি আরও জানান, সরকারের আইন-কানুন মেনে বস্তিতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু বর্তমানে রয়েছেন আতঙ্কে। কারণ অপহরণকারী ও খুনীরা মিয়ানমারের আল ইয়াকিনের পক্ষ হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-বস্তিগুলোতে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
×