ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসাদুজ্জামান কাজল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর ক্ষমতায়ন

প্রকাশিত: ০৭:০২, ৭ জুলাই ২০১৭

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীর ক্ষমতায়ন

বঙ্গ অঞ্চলে নারী শিক্ষার বিষয়টি প্রথম গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপিত হয় উনিশ শতকে। এই সময় নারীবাদী আন্দোলনেরও প্রধান বিষয় হয়ে উঠে নারী শিক্ষা। উনিশ এবং বিংশ শতকের শুরুতে যেসব লেখক সমাজ সংস্কারের বিষয়ে লিখতেন তাদের লেখারও প্রধান বিষয়ই ছিল নারী শিক্ষা। উনিশ শতকে বাংলার মুসলমান নরীরা অন্দর মহল থেকে দুই ধরনের শিক্ষা গ্রহণ করত। উচ্চ শ্রেণীর মুসলমান নারীরা কোরান শিক্ষা ও কিছু উর্দু শিক্ষা গ্রহণ করত এবং নিচু শ্রেণীর মুসলমান নারীরা কিছু ধর্মীয় কাহিনী এবং কিছু হাদিসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। এই দুই শ্রেণীই শিক্ষা গ্রহণ করত পারিবারিক জীবনে অবদান রাখতে। অন্যদিকে হিন্দু, খ্রিস্টান ও অন্য ধর্মের নারীরা ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজী, সেলাই ও সঙ্গীত বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করত। এ কারণেই এই অঞ্চলের মুসলমান মেয়েদের তুলনায় হিন্দু মেয়েরা শিক্ষায় এগিয়ে যায়। এই অঞ্চলে নারী শিক্ষায় খ্রীস্টান মিশনারীরা ছিল পথ প্রদর্শক। রবার্ট মে নামের একজন ইংরেজ মিশনারী ১৮১৮ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৭০ সাল পর্যন্ত কলকাতা ও ঢাকায় নারী শিক্ষার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালায় এসব মিশনারী স্কুল। কিন্তু, দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব মিশনারী স্কুলে মুসলমান নারীর উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। চার্চ মিশনারী সোসাইটির পৃষ্ঠপোশকতায় মিস মেরি এ্যান কুক ১৮২৩-১৮২৮ সালের মধ্যে অনন্ত ৩০ টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এই অঞ্চলে। ১৮৫৭-১৮৫৮ এই এক থেকে দেড় বছরে বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া ও মেদিনীপুরে নারী শিক্ষার জন্য প্রায় ৩৫টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্কুলগুলো খুব দ্রুত বন্ধ হয়ে গেলেও নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি ছিল একটি মাইলফলক ঘটনা। এই সময়ে বাংলার নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনুপ্রেরণা দিয়েছিল নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী। নারীরা যখন পশ্চিমা শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন তিনিই প্রথম অনুধাবন করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া নারী মুক্তি সম্ভব নয় এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিস্তারের জন্য তিনি কিছু বালিকা বিদ্যালয়ও এই সময় প্রতিষ্ঠা করেন। নবাব ফয়জুন্নেছার চিন্তাধারাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে এই অঞ্চলের নারী মুক্তির জন্য কাজ করেছেন বেগম রোকেয়া। তিনি দ্বারে দ্বারে ঘুরে অভিভাবকদের বোঝাতেন তাদের মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর জন্য। বেগম রোকেয়ার এই চিন্তাধারাকে আরেকটু সামনে এগিয়ে নেন তার অনুজপ্রতিম শামসুন্নাহার মাহমুদা। কলকাতায় যখন নারী শিক্ষায় নানা ঘটনা ঘটছে তখন ঢাকাতেও মিশনারী স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারী শিক্ষা অগ্রসর হচ্ছিল। বাংলাদেশে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রাখে ১৮৮০ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ইডেন গার্লস হাইস্কুল। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যেটি এই বাংলায় নারী শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন নীলা নাগ। তিনি ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হন ১৯২১ সালে। ১৯৩৫ সালে প্রথম নারী শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে যোগদান করেন করুণাকণা গুপ্ত। যেটি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক ঘটনা। প্রথম বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন মাত্র একজন। তারপর প্রতিবছরই দু-একজন করে বাড়তে থাকে এবং ১৯২১-১৯৫২ পর্যন্ত সর্বমোট ৭১১ জন নারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে এখানে। আজ জাতীয় জীবনে যেসব নারী নেতৃত্ব দিচ্ছে তা প্রায় সবই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও স্পীকার তাঁরই বড় উদাহরণ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, প্রেস ক্লাবের প্রথম নারী সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াছমিন, বর্তমান প্রশাসনের মোট ৯ নারী সচিবের মধ্যে সুরাইয়া বেগম, মুশফেকা ইকফাৎ, বেগম শামসুন নাহার, নাছিমা বেগম, কানিজ ফাতেমাসহ প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আবার বর্তমানে দেশে যে মোট নয়জন নারী জেলা প্রশাসক রয়েছেন তারাও প্রায় সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। জাতীয় রাজনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, আইভি রহমান, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, খুশী কবির, উন্নয়ন কর্মী রাশেদা কে. চৌধুরী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ সৈয়দ রিজওয়ানা হাসান, বিখ্যাত শিল্পী সাবিনা ইয়াছমিনসহ বহু নারী যারা আজ দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই অসাধ্য কাজটি সাধন করতে পেরেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদার চিন্তা-ভাবনার কারণেই। উপমাহাদেশের যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কোন ব্যক্তির শিক্ষার্থী হতে কোন আইনগত বাধা ছিল না। যে কথা Dhaka University অপঃ ১৯২০ (XVII of 1920) - তেই বলা হয়েছিল ‘The University shall be open to all persons of either sex and of whatever race, পৎববফ ড়ভ পষধংং ধর্মীয় রক্ষণশীলতার জন্য পাকিস্তানের নারী শিক্ষা যেখানে পদে পদে বাধাগ্রস্ত সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থানের জন্য নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ আজ রোল মডেল। শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে ছিল খুব তৎপর। বর্তমানে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ থাকায় এখন প্রায় প্রতিটি বিভাগে নারী শিক্ষার্থী প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করছে। যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা বিভাগে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে তাদেরকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়Ñ সেজন্যই বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষকদের এক বিশাল অংশ নারী। ভাল ফলাফলস্বরূপ বিশ^বিদ্যালয় থেকে যেসব শিক্ষা বৃত্তি দেয়া হয় তার প্রায় সিংহভাগই দখল করে রেখেছে নারী শিক্ষার্থীরা। গত ৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০তম সমাবর্তনে ৮০ জনকে স্বর্ণপদক দেয়া হয়। এর মধ্যে ৪২টিতে নারীরা স্বর্ণপদক পায়। এমফিল ও পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনেও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা যেমন দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তেমনি নেতৃত্ব দিচ্ছে স্বয়ং এই বিশ্ববিদ্যালয়কেও। বর্তমানে বাংলা, ইংরেজী, রোবেটিক্স এ্যান্ড মেকানিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, আবহাওয়া বিজ্ঞান, ক্লিনিক্যাল ফার্মেসী ও ফার্মাকোলজি, অণুজীব বিজ্ঞান, রসায়ন, মনোবিজ্ঞান, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র অধ্যায়ন, অর্থনীতিসহ প্রায় ১৬টি বিভাগ ও ৫ ইনস্টিটিউটের নেতৃত্ব দিচ্ছে নারী। শুধু বিভাগে নয়, বিশ^বিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল নীল দলের আহ্বায়ক নাজমা শাহীনের নেতৃত্বেই গত ২২ মে সিনেটে ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে- নীল দল ৩৩টি আসনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম। এবং গত শিক্ষক নির্বাচনে ১৫টি আসনের মধ্যে ১৫টি আসনেই বিজয়ী হয় আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের প্যানেল নীল দল। যেটাও সম্ভব হয়েছে নীল দলে আহ্বায়ক নাজমা শাহীনের নেতৃত্বেই। সৃষ্টির শুরু থেকে বাঙালীর মুক্তির জন্য লড়াই করে আসছে প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালী নারীর মুক্তির প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল ১৯২১ সালে নীলা নাগের ভর্তির মাধ্যমে। এই স্বল্প পথ চলায় এই বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে একটি স্বাধীন ভূখ- ও স্বাধীন ভূখ-ের স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। এই স্বল্প সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে শেখ হাসিনার মতো বিশ্ব নন্দিত প্রধানন্ত্রীকে। এই স্বল্প সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় জন্ম দিয়েছে বহু বিশ্ব বরণ্যে শিক্ষক, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের। এটাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে বড় সফলতা। হাজার বছর ধরে বাঙালী নারী মুক্তির প্রথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করুক প্রাণের এই বিশ্ববিদ্যালয়।
×