ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাঝে মাঝেই ঘটছে ছোট ছোট পাহাড়ধস, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বান্দরবানে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ৫ জুলাই ২০১৭

মাঝে মাঝেই ঘটছে ছোট ছোট পাহাড়ধস, ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা বান্দরবানে

মোয়াজ্জেমুল হক/মোহাম্মদ আলী/জীতেন বড়ুয়া/এস বাসু দাশ ॥ ভারি বর্ষণে জলজট, পাহাড় ধস, প্রাণহানি, সহায় সম্পদ ধ্বংসের ঘটনায় চট্টগ্রাম ও পাহাড়ের তিন জেলায় নজিরবিহীন মহাদুর্যোগ মানুষকে গ্রাস করে রেখেছে। সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করে রেখেছে পাহাড় ধসের মাটিচাপা পড়ার ঘটনা। গত ১৩ জুন পাহাড়ের রাঙ্গামাটি জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ও পাহাড় ধসের ঘটনার পর মানুষের মাঝে কোনভাবেই স্বস্তি ফিরে আসছে না। আষাঢ় মাসে বর্ষণ অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। কিন্তু এবার এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধস ও ঢলে বেসামাল পরিস্থিতি। কোনক্রমেই বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মানুষ জলজটের দুর্বিসহ অবস্থা থেকে যেমন মুক্তি পাচ্ছে না, তেমনি রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়ী-বাঙালী নির্বিশেষে পাহাড় ধসের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারি বর্ষণে সৃষ্ট ঢল। মাতামুহুরি নদী যেন ঢলের পানিতে উপচে পড়ছে। ফলে লামা আলীকদম এলাকায় হাজার হাজার লোক পানিবন্দী হয়ে আছে। গত তিনদিনে নতুন নতুন এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তবে প্রাণহানির তেমন কোন ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। নির্বিচারে পাহাড় কেটে মানুষ নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেয়ার পর এবার পাহাড় এর প্রতিশোধ নিচ্ছে নির্মমভাবে। এ বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে সবচেয়ে বেশি। কারণ হিসেবে যত কথাই বলা হোক না কেন, পাহাড়জুড়ে একযোগে ধস ও ফাটলের বিষয়টি নজিরবিহীন ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রাকৃতিক এ মহাদুর্যোগের বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো কোনভাবে কুলিয়ে উঠতে পারছে না। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যত ব্যবস্থাই নেয়া হোক না কেন, পুন ভারি বর্ষণে গৃহীত সার্বিক ব্যবস্থাও যেন ল-ভ- হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি এমন হয়েছে যে, সকলের মাঝে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা গভীর থেকে দিন দিন গভীরতর হচ্ছে। এর উত্তরণে ইতোমধ্যে নানা বক্তব্য যেমন এসেছে, তেমনি ব্যবস্থার কথাও উঠে এসেছে। কিন্তু সবই হবে পর্যায়ক্রমে। কিন্তু তার আগেই একাকার করে দিচ্ছে ধস ও ঢলে সহায় সম্পদ ধ্বংস ও প্রাণহানির ঘটনা। চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় আষাঢ়ী ভারি বর্ষণে একদিকে নতুন নতুন এলাকায় জলজট সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি পাহাড়ে পুরনো ও নতুন নতুন স্থানে ধস সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে সংশ্লিষ্ট এলাকাসমূহে দুর্যোগ পরিস্থিতির অবনতিও ঘটছে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের সাপছড়ি এলাকায় পাহাড় ধসের ভয়াবহ ঘটনার পর নতুন করে যে রাস্তা নির্মিত হয়েছে ঠিক তার অনতিদূরে গত সোমবার পাহাড় ধসস্তূপ সরানো হলেও আরও পাহাড় ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি সরাসরি যোগাযোগ গত ১৩ জুনের পর থেকে এখনও বন্ধ রয়েছে। এলাকার বগাছড়ির বেশ কয়েকটি স্থানে ভূমিধসে এ প্রতিবন্ধকতার জন্ম নিয়েছে। অপরদিকে, বান্দরবানে ভারি বর্ষণের কারণে সাঙ্গু নদীতে ঢলের পানিতে উপচে পড়ছে। এর ফলে থানছি, ছোট মদকসহ পর্যটক গমনাগমনের স্থানসমূহে জন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে নতুন পাহাড় ধসের ঘটনায় লামা ও আলী কদম সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বসবাসরতদের আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য নতুনভাবে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ঢলের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আলীকদ উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গৃহবন্দী হয়ে পড়েছে। গত দু’দিনের প্রবল বর্ষণে রাঙ্গামাটিতে আরও কয়েকটি আস্তানায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে রাঙ্গামাটি থেকে পাঁচটি সড়কে হালকা যানবাহন চলাচল হুমকির মুখে রয়েছে। তবে মঙ্গলবার থেকে সাপছড়িতে বেইলী ব্রিজ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। অপরদিকে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও জলজটে একাকার হয়ে আছে। গত কয়েকদিন ধরে কখনও হালকা, কখনও ভারি বর্ষণে এ পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে। গত সোমবার ব্যাপক আকারে নতুন নতুন এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। স্বাভাবিক জীবন থমকে যায়। শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানামার কাজও ব্যাহত হয়। বহির্নোঙ্গরে জাহাজ থেকে পণ্যের ডেলিভারি কাজ সোমবার থেকে এখনও বন্ধ রয়েছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় সংস্কার কাজ দফায় দফায় ব্যাহত হতে থাকায় সামগ্রিক পরিস্থিতিতে ব্যাপকভাবে উন্নতি ঘটানো যাচ্ছে না। সবমিলে চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড় ধস ও ঢলের কারণে জানমাল ও সহায় সম্পদের ক্ষতি নজিরবিহীন। চট্টগ্রামে ইতোপূর্বে শুধুমাত্র নিম্নাঞ্চল জলজটে নিমজ্জিত থাকত। এবারের ভারি বর্ষণে যেভাবে নতুন নতুন এলাকা পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে তাতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সঙ্কটে যেমন রয়েছে, তেমনি নগরবাসীও চরম দুর্ভোগে পড়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ চূড়ান্তভাবে নির্ণয় করা একদিকে যেমন কঠিন, তেমনি এসব এলাকা জলজটমুক্ত রাখা আরও কঠিন। কেননা, ভারি বর্ষণে নগরীতে জমে থাকা পানি দ্রুত সরে যাওয়ার কোন পথ খোলা নেই। নগরীর বিভিন্ন স্থানে ৪০টিরও বেশি যে খাল রয়েছে এসব খালগুলো বহু বছর ধরে ভরাট হতে থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ইতোমধ্যেই দায়ীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এও দাবি করেছেন অনাকাক্সিক্ষত এ পরিস্থিতির জন্য কর্পোরেশন দায়ী নয়। সম্মিলিতভাবে সকল সংস্থা ও নগরবাসী এগিয়ে না এলে এ সমস্যার উত্তরণ ঘটবে না। খাগড়াছড়িতে ভারি বর্ষণে বিভিন্ন পাহাড়ে নতুন নতুন ধস হচ্ছে। মঙ্গলবার বেশ কয়েকটি স্থানে ধসের মাটি চাপা পড়ে কয়েকটি বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোপূর্ব থেকে খোলা ৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিতদের থাকার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। বর্ষণের কারণে সর্বত্র পাহাড় ধস আতঙ্ক বিরাজ করছে। মঙ্গলবার সকালে শহরের শালবন, হরিনাথপাড়া, আঠার পরিবার এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। তবে এতে কোন প্রাণহানি ঘটেনি। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরতরা নিয়মিত পাহাড়ে বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখায় ভারি বৃষ্টিতে ধসের সৃষ্টি হচ্ছে। খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার নির্বাহী দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহ থেকে মানুষজনকে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং অব্যাহত রাখা হয়েছে। গত ১৩ জুন পাহাড় ধসের ঘটনায় খাগড়াছড়িতে ৭ জনের মৃত্যু ঘটে। রাঙ্গামাটি পরিস্থিতিতেও নতুন করে পাহাড় ধসের আশঙ্কা ব্যাপকভাবে উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। সোমবার সাপছড়ি এলাকায় বড় একটি পাহাড় থেকে ধস নামার পর কয়েকঘণ্টার জন্য সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকে। সড়ক বিভাগের লোকজন দ্রুত বুলডোজার দিয়ে ধসস্তূপ সরিয়ে ফেলার পর যোগাযোগ পুনর্প্রতিষ্ঠা হয়। জেলার অধীন ১০ উপজেলা জুড়ে ভারি বর্ষণে দুর্ভোগ বেড়েছে। স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেমন থমকে গেছে, তেমনি নতুন নতুন পাহাড় ধসের আশঙ্কা নিয়ে মানুষ উৎকণ্ঠিত অবস্থায় রয়েছে। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কে সাপছড়ি এলাকায় হালকা যানবাহন চলাচল অব্যাহত রাখতে সড়ক বিভাগের চারটি টিম অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে ভারি বৃষ্টির কারণে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি সড়কের সাত ও আট কিলোমিটার পয়েন্টে নতুন করে মাটি ভরাটের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। নতুন নতুন পাহাড় ধস আতঙ্কে রাঙ্গামাটির আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ভেদভেদি, রূপনগর ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে নতুন নতুন ক্ষতিগ্রস্তরা আশ্রয় নিয়েছে। সর্বত্র রয়েছে নতুন করে পাহাড় ধসের আতঙ্ক। গত ১৩ জুনের মহাদুর্যোগের পর আশ্রয় কেন্দ্র থেকে যারা ফিরে গিয়েছিল তাদের বড় একটি অংশ আবার আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে শুরু করেছে। ধসের আতঙ্কের কারণে পশ্চিম মুসলিমপাড়া ও শিমুলতলি এলাকা থেকে শতাধিক মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোঃ মানজারুল মান্নান। ১৩ জুন সৃষ্ট মহাদুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয়ে সমন্বয়ে গড়া ১৪ সদস্যের একটি টিম মঙ্গলবার রাঙ্গামাটি পৌঁছেছেন। সন্ধ্যায় তারা জেলা প্রশাসকের দফতরে মতবিনিময়ে অংশ নেন। বান্দরবানের মাতামুহুরি নদীর পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় লামা ও আলী কদমের উপজেলা পরিস্থিতিতে ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। থানছি, রেমাক্রী, বড়মদক ও ছোট মদকে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে নতুন করে পাহাড় ধসে পড়েছে। ফলে বান্দরবানের সঙ্গে এ দুই উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। লামা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান থোয়াইনু অং চৌধুরী জানিয়েছেন, বর্ষণ অব্যাহত থাকলে জেলা সদরের সঙ্গে লামার পাশাপাশি চট্টগ্রাম-বান্দরবান সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। গত তিনদিন ধরে চট্টগ্রাম ও পার্বতাঞ্চলের তিন জেলায় থেমে থেমে ভারি বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন স্থানে নতুন করে দুর্যোগ বয়ে এসেছে। তবে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত করে রেখেছে পাহাড় ধস। গত ১৩ জুনের ঘটনার পর থেকে এ আতঙ্ক মানুষের মাঝে কেবলই বাড়ছে। আকাশে মেঘ দেখলে মানুষের মাঝে বৃষ্টির শঙ্কা যেমন নেমে আসে, তেমনি বড় উৎকণ্ঠার জন্ম দেয় কখন কোন পাহাড় ধসে পড়ছে। আর এতে করে নতুন নতুন করে জানমালের ক্ষতি ডেকে আনছে। মোট কথা, এবারের বর্ষা মৌসুমে যে পরিস্থিতির জন্ম নিয়েছে, তা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি সর্বত্র জলজট ও পাহাড়ী ঢলে একাকার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিন জনজীবনকে দুর্বিসহ করে রেখেছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণে সরকারী বিভিন্ন প্রশাসনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও একযোগে করে যাচ্ছে। কিন্তু সার্বিকভাবে এর স্থায়ীত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে আছে। একদিকে, নতুন করে সড়ক নির্মিত হচ্ছে, আরেকদিকে পাহাড় ধসছে। এ যেন প্রকৃতি দীর্ঘদিন পর প্রতিশোধের খেলায় মেতে উঠেছে।
×