ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ আব্দুল বাকী চৌধুরী নবাব

অর্থবছর জানুয়ারি টু ডিসেম্বর হলে সাশ্রয় হবে কোটি টাকা

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২ জুলাই ২০১৭

অর্থবছর জানুয়ারি টু ডিসেম্বর হলে সাশ্রয় হবে কোটি টাকা

অধুনা পত্র-পত্রিকায় একটি বিষয় লক্ষণীয়, ভারতে জানুয়ারি টু ডিসেম্বর অর্থবছর শুরু করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়সহ বুদ্ধিজীবী মহলে চিন্তা ভাবনা চলছে। এটা সর্বজন স্বীকৃত, একটি দেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় না এনে অর্থবছরের সময়কাল যদি নির্ধারিত করা হয়, তাহলে সে দেশকে আর্থিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কিউমুলেটিভ দৃষ্টিকোণ থেকে খেসারত দিতে হয়। তাই বাংলাদেশের যে অর্থবছর জুলাই টু জুন ধরে চলে আসছে, সেটা বাংলাদেশের জন্যে মোটেই অনুকূল এবং হিতকর নয়। আর বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। ব্রিটিশ ভারতে বার্ষিক বাজেটের প্রচলন শুরু হয় ১৮৬১ থেকে এবং ১৯২১ সাল হতে “ইঁফমবঃ ্ অপপড়ঁহঃরহম অপঃ’’-এর হাত ধরে এগুতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিক প্রথম বাজেট পেশ করে ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল এবং সেই থেকে এ অঞ্চলে বাৎসরিক বাজেটের ভীত সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ-ভারতে অর্থবছরের শুরু এপ্রিল এবং শেষ হতো মার্চে। সেটিই এখন পর্যন্ত ভারতে চলছে। অথচ তৎকালীন পাকিস্তানে পরিবর্তিত করে জুলাই টু জুন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সময়ের সংস্কৃতিটি (ঞরসব ঙৎরবহঃবফ ঈঁষঃঁৎব) তিন সালের ওপর ভিত্তি করে (যেমন, ইংরেজী, হিজরী ও বাংলা সাল) চলে। তবে ঔপনিবেশিক ইংরেজী সালই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তাই ইংরেজী সাল, ‘‘জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর” পর্যন্ত সময়কাল প্রায় আড়াই শ’ বছর ধরে নানা শাখা-প্রশাখা নিয়ে ইংরেজী কৃষ্টি কম-বেশি আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। আমরা বাঙালী ভাবাপন্ন হলেও ইংরেজী সংস্কৃতি থেকে আমাদের প্রায় সব কিছু ধার করা। সেহেতু তথ্যপ্রযুক্তিসহ গ্লোবাল সংস্কৃতি হিসেবে ইংরেজী পঞ্জিকাপ্রসূত সময় বাদ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বিগত ৪৫ বছরে করদাতাদের কাছ থেকে যত টাকা পাওয়ার কথা ছিল, তা সময় মতো পাওয়া যায়নি। কারণ করদাতাদের বিরাট একটি অংশ কৃষককুল। তাদের কাছে কমবেশী যাই টাকা থাকুক না কেন, তা থাকে মূলত ফসল কাটার সময়ে (ঐবৎাবংঃরহম ঞরসব)। কেননা দরিদ্রতার কারণে ভিসিয়াস সার্কেলের আওতায় তাদের কাছে অতিরিক্ত অর্থ গচ্ছিত থাকে না। তাই কৃষি নির্ভরশীল বাংলাদেশের কর ও অভিকর আদায়ের মোক্ষম সময় হেমন্তকাল অর্থাৎ নবেম্বর ও ডিসেম্বর। কিন্তু যেহেতু অর্থবছর শুরু হয়েছে জুলাই মাসে তাই সে সময় এবং তৎপূর্বাহ্নে কর আদায় করা দুষ্কর এবং এখনও সে অবস্থা বিদ্যমান। যদিও এটি দুর্বল যুক্তি, তথাপিও খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। অর্থবছরের শুরু ও শেষের মাসদ্বয় (জুলাই টু জুন) হলো বর্ষাকাল এবং এ সময়ে প্রায়ই দুর্যোগ কবলিত থাকে বিধায় উন্নয়ন কাজ যথাযথ করা সম্ভব হয় না। তাই ঋরহধহপরধষ ্ চযুংরপধষ চৎড়মৎবংং-এর মধ্যে ব্যবধান (ঠধৎরধহপব) সৃষ্টি হয়। অনেক সময়ের এ কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যায় এবং পি পি বার বার সংশোধন করতে হয়। বাংলাদেশের মানি মার্কেটের আওতাধীন তফসিলী ৪৯টি ব্যাংকসহ বীমা ও লিজিং কোম্পানির বাজেট ও চূড়ান্ত হিসাব ইংরেজী ক্যালেন্ডার বছর ধরে করা হয়। কেবল ষান্মাসিকভাবে জুন ক্লোজিং করা হয় অথচ অর্থবছর ভিন্নতর হওয়ায় অযথা ঝামেলা ও ডুপ্লিকেট কাজ করতে হয়। যদি জাতীয়ভাবে ইংরেজী ক্যালেন্ডার বছর ভিত্তি করে বাজেট করা হতো, তাহলে মানি মার্কেটের আওতায় প্রায় সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এতদ্ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সহজতর হতো এবং সর্বশেষ হালনাগাদ সরকারী ক্রয়নীতিমালা (চচজ) যথাযথ বাস্তবায়নের পথ সুগম হতো। ফলে আর্থিক সাশ্রয় হওয়ার কথা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এটি পর্যালোচনা করে বোঝা যায়, এ বিশ্বের ছোট বড় ২৩২টি দেশের মধ্যে ৭২% এর বেশি দেশে ইংরেজী ক্যালেন্ডার বছর অনুসরণ করে, যা এষড়নধষরুধঃরড়হ-এর আওতায় অধিকাংশ মানুষের গ্রাহ্য সময় ও গবফরধ ঞরসব ঋধপঃড়ৎ নানা দেশের আচার, ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া, সংস্কৃতি ইত্যাদির ভিন্নতা থাকলেও আন্তর্জাতিক ঈধষবহফধৎ ুবধৎ বলতে জানুয়ারি টু ডিসেম্বর বুঝায় এবং যা বিশ্ববাসী পুরোপুরি মেনে নিয়েছেন বললে অত্যুক্তি হবে না। যেখানে পৃথিবীর প্রায় দেশ জানুয়ারি টু ডিসেম্বর অনুসরণ করছে এবং বাকি দেশগুলো দ্রুত পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। সেখানে গতানুগতিক জুলাই টু জুনের অর্থবছর পদ্ধতি বন্ধ করাই বিধেয়। কেননা এতে অযথা সময় দ- এবং প্রভূত অর্থদ- দিতে হয়। এদিকে বাংলাদেশের বেসরকারী সকল প্রতিষ্ঠান তাদের মতো করে বছর অনুসরণ করে। তারা জুলাই টু জুনের কোন ধার ধারে না। আমাদের অর্থনীতি অনেকাংশে বৈদেশিক ঋণ, অনুদান, ইত্যাদির ওপর নির্ভরশীল। বিগত বছরগুলোতে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিবছর অনুষ্ঠিত এইড টু কনসোর্টিয়ামে প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা ঠিকমতো প্রতিপালিত হয় না বিধায় তিন কিস্তির টাকা অর্থবছরের শেষে অর্থাৎ মে/জুন মাসে পাওয়া যায়। তখন তো বাংলাদেশের আবহাওয়া ও ভৌগোলিক অবস্থা অনুযায়ী ঝড়-বৃষ্টি থাকে। তখন তড়িঘড়ি করে কাজ করতে গিয়ে একদিকে অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে শত শত কোটি টাকা ভেস্তে যায়, আর এতে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে ‘সময়’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। কেননা সময় উপযোগিতা (ঞরসব টঃরষরঃু) সর্বক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তাই বিকল্পের অন্যতম পথ হিসেবে অর্থবছর তথা জানুয়ারি টু ডিসেম্বরকে বেছে নেয়া দরকার। ১৯৭২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে ৪৫টি অর্থবছরের শুরু ও শেষ নিয়ে যে প্রশ্নœ উত্থাপিত হয়েছে, সে ব্যাপারে আর্থিক ক্ষতি তথা অর্থনৈতিক ক্ষতি নিরূপণ করা সুকঠিন। তবে আমাদের কিছুটা তলিয়ে দেখা আবশ্যক বলে মনে করি। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে কেবল বাংলাদেশে সঠিক অর্থবছর ধরে না চলার কারণে কয়েক বছরে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তাতে পদ্মা সেতু অনায়াসে হয়ে যেত। আর এটাকে ইস্যু করে এত ডামাডোল হতো না, কেননা কারও কাছে হাত পাততে হতো না। আর তখন বল আমাদের কোর্টে থাকত। সেহেতু অযথা এ গতানুগতিক সময়কাল ধরে অনাহুত ভার বোঝা পিছনে ফেলে দিয়ে যদি বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষাপটে অর্থবছর শুরু ও শেষের সময় পরিবর্তনপূর্বক এগিয়ে যাই। তাহলে অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল আমাদের হাতের মুঠোয় এসে যেত। উল্লেখ্য, অর্থবছরের শুরু ও শেষসহ সময়কাল দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অপরিহার্য এবং কেননা অন্যতম প্রধান সহায়ক নিয়ামক হিসেবে “সময়কাল” গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের প্রথম বাজেট (১৯৭২-৭৩) ছিল মাত্র ৭৮৬.০০ কোটি টাকা মাত্র। যা তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মরহুম তাজউদ্দিন আহমেদ কর্তৃক ৩০/০৬/১৯৭২ সংসদে পঠিত হয়। অথচ এই দীর্ঘ ৪৫ বছরের মাথায় (২০১৭-১৮) সেই বাজেটের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ কোটি টাকার ওপরে, যা পহেলা জুন ২০১৭ তে সংসদ পরিবেশন হতে যাচ্ছে। কিন্তু সকল প্যারামিটার বিবেচনায় এনে সঠিক অর্থবছর নির্ধারণ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে যতদ্রুত সম্ভব সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। ততই আমাদের খেটে খাওয়া মানুষের ও ধান শালিকের দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে।
×