ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

* নির্বাচন ও গ্রীষ্ম সামনে রেখে নতুন পরিকল্পনা;###;* বিনিয়োগ হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা

নয় মাসের মধ্যে তেল চালিত তিন হাজার মেও বিদ্যুত কেন্দ্র

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১ জুলাই ২০১৭

নয় মাসের মধ্যে তেল চালিত তিন হাজার মেও বিদ্যুত কেন্দ্র

রশিদ মামুন ॥ আগামী ৯ মাসের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করতে চায় সরকার। নির্বাচন এবং আগামী গ্রীষ্মকে সামনে রেখে নতুন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। নতুন এসব বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। দেশীয় উৎস থেকে তেলচালিত এসব বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হবে। ইতোমধ্যে এসব বিদ্যুত কেন্দ্রের জন্য প্রস্তাব জমা নেয়া শুরু হয়েছে। বিনা দরপত্রে দরকষাকষির মাধ্যমে এসব বিদ্যুত কেন্দ্রের ইউনিটপ্রতি দাম নির্ধারণ করা হবে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, বিদ্যুত সচিব এবং বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানকে এ বিষয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এরমধ্যেই আগ্রহী নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বিদ্যুত বিভাগ। সম্প্রতি দেশের সরকারী-বেসরকারী ব্যাংকগুলোকে এসব প্রকল্পে বিনিয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। স্বল্প সময়ে বিদেশী বিনিয়োগ যোগাড় করতে না পারায় বিকল্প এ পন্থায় অর্থ সংগ্রহ করার চিন্তা করা হচ্ছে। জানতে চাইলে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী গ্রীষ্মের আগেই এসব বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। মূলত চলতি গ্রীষ্মে এক হাজার মেগাওয়াটের ঘাটতি রয়েছে। এর বাইরে আগামী গ্রীষ্মে আরও এক হাজার ৫০০ মেগাওয়াটের নতুন চাহিদা তৈরি হবে। এজন্য সরকার চিন্তা করছে সব মিলিয়ে অন্তত তিন হাজার মেগাওয়াটের নতুন বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আনতে। সূত্র জানায়, চলতি গ্রীষ্মে কয়েকদিন তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুতের সঙ্কট তৈরি হয়। এতে বিদ্যুতের প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণে সবার টনক নড়ে। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের এ সময় সঠিক পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে না পারায় ভর্ৎসনা করা হয়। সঙ্কট সামাল দিতে নানামুখী পরিকল্পনা নিয়ে শহরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হলেও গ্রামে সঙ্কট রয়েই গেছে। এরপরই তেলচালিত নতুন কেন্দ্র নির্মাণ করে সঙ্কট সামাল দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে দ্বিতীয় মেয়াদে সেভাবে বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে আসেনি। বিশেষ করে যেসব বেসরকারী উদ্যোক্তাকে কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের কাজ দেয়া হয়েছে তাদের কেউ নির্মাণই শুরু করেননি। এতে চাহিদার সঙ্গে বিদ্যুত উৎপাদনের ভারসাম্য হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। বেসরকারী কয়লাচালিত আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজ পেয়েছেন এমন কেউই বিদ্যুত কেন্দ্রের অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেননি। এমনকি তারা জমিরও সংস্থান করতে পারেননি। দ্বিমুখী জটিলতায় সরকরা সহায়তার হাত বাড়ালেও কোন কোম্পানি সাফল্য দেখাতে পারেনি। সঙ্গত কারণে তড়িঘড়ি করে স্বল্পমেয়াদী কেন্দ্র নির্মাণ করার এ সিদ্ধান্তের দিকে সরকরাকে ঝুঁকতে হয়েছে। বিদ্যুত বিভাগ মনে করছে, মোট তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে কমপক্ষে ১৮ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে (প্রতি মেগাওয়াটে ৬ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়)। কিন্তু এত অল্প সময়ে দেশের বাইরের বিনিয়োগ সংস্থান করা সম্ভব নয়। উপরন্তু দেশের বাইরের বিনিয়োগকারীরা সাধারণত তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রে অর্থলগ্নি করতে চান না। এজন্য বিদ্যুত বিভাগ দেশীয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে উদ্বুদ্ধ করছে। বেসরকারী উদ্যোক্তারা কেন্দ্র নির্মাণ করলেও বিদ্যুত বিভাগ তাদের সহায়তা করার জন্য সম্প্রতি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। বিদ্যুত বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, সরকার ব্যাংকগুলোকে অর্থ ফেরতের নিশ্চয়তা দিলে তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। এজন্যই এ ধরনের কাজ করা হয়েছে। যেহেতু বিদ্যুত ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী পিডিবি সরকারের পক্ষে সব বিদ্যুত ক্রয় করে। সরকার চাইলেই ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে উদ্যোক্তারা। তিনি জানান, সরকার মূলত বেসরকারী উদ্যোক্তাদের দিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণে আগ্রহী। তবে সরকারী কোম্পানিগুলোকেও তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারী কোম্পানির কেউ এ ধরনের বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করলে তাকে বাড়তি প্রাপ্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, আগামী বছর থেকে রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্রের অবসরে যাওয়া শুরু হবে। এসব বিদ্যুত কেন্দ্রই তেলচালিত। তেলচালিত বিদ্যুত কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় বেশি। সরকার ২০০৯ সালের পর রেন্টাল বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের সময় বলেছিল বড় বিদ্যুত কেন্দ্র উৎপাদনে এলে এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু এখন এসে আবার তেলের দিকেই ঝুঁকতে হচ্ছে। এসব বিদ্যুত কেন্দ্র ছোট আকারের হওয়ায় উৎপাদন ব্যয় বেশি পড়ে, যাতে বাজেটে বিদ্যুত উৎপাদনে সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর মধ্যে কেবলমাত্র পায়রা বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণকাজ যথাসমেয় শেষ হবে। অন্য কোন বিদ্যুত কেন্দ্রের কাজই নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হবে না। এতে বিশাল বিদ্যুত ঘাটতিতে পড়তে হবে। বিদ্যুত বিভাগ সূত্র বলছে, ২০২৫ সাল নাগাদ যে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে তাতে মাত্র তিনটি বড় বিদ্যুত কেন্দ্র আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এ তিনটি বিদ্যুত কেন্দ্র হলোÑ পায়রা, রামপাল এবং মাতারবাড়ি। সব মিলিয়ে বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে তিন হাজার ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সরকারের ২০২১ সাল নাগাদ দেশে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও কোন প্রকল্পের অগ্রগতি না থাকায় বিদ্যুত উৎপাদন নিয়ে চিন্তিত সরকার। সম্প্রতি সরকারের পরিকল্পনায় তিন হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের নির্মাণ পরিকল্পনার স্থান নির্ধারণ চূড়ান্ত করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় দেখা যায়, ৭০০ মেগাওয়াটের বার্জ মাউন্টেন্ড এবং এক হাজার মেগাওয়াটের স্থায়ী বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর সবকটিই বিনা দরপত্রে বিদ্যুত-জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বিশেষ আইনের মাধ্যমে নির্মাণের চিন্তা করছে বিদ্যুত বিভাগ। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, বার্জ মাউন্টেন্ড ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্রের মধ্যে কক্সবাজারে ২০০ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহে ২০০ মেগাওয়াট, চাঁদপুর, নওয়াপাড়া এবং বাগেরহাটে ১০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এছাড়া চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ৩০০ মেগাওয়াটসহ মাগুরা, যশোর, লালমনিরহাট, নওগাঁর নিয়ামতপুর ও জয়পুরহাটে ১০০ মেগাওয়াট এবং গাজীপুরের ভালুকায় ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এসব বিদ্যুত কেন্দ্রের পাওয়ার ইভাক্যুয়েশন কিভাবে হবে তাও নির্ধারণ করেছে বিদ্যুত বিভাগ। এছাড়া বাকি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের জন্য রেলওয়ের কাছে জমি চাইছে বিদ্যুত বিভাগ। এ বিষয়ে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের কাছে জমি চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিদ্যুত বিভাগ। বিদ্যুত বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, আইপিপি বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের বিভিন্ন শর্তেও এবার ছাড় দেয়া হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ে কেন্দ্র নির্মাণে ব্যর্থ হলে যে ধরনের জরিমানা দেয়ার বিধান রয়েছে তাতেও ছাড় দেয়া হচ্ছে। মূলত আরও বেশি উদ্যোক্তাকে সম্পৃক্ত করতে এ উদ্যোগ বলে জানা গেছে।
×