ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এ মহাদুর্যোগ মনুষ্যসৃষ্ট ;###;মাথা ন্যাড়া করায় অতিবর্ষণের ধকল সইতে পারেনি;###;ঢাল কেটে বসতি স্থাপন ও স্থাপনা গড়ে তোলায় ভর সইতে পারেনি নিচের মাটি

পাহাড় ধসের নেপথ্যে

প্রকাশিত: ০৬:০৬, ২২ জুন ২০১৭

পাহাড় ধসের নেপথ্যে

শাহীন রহমান ॥ তিন পার্বত্য জেলার সাম্প্রতিক পাহাড়ধস মানবসৃষ্ট। নির্বিচারে পাহাড় কেটে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরি, জলাশয় ও খাল ভরাট, পাহাড়ের নিকটবর্তী নদীগুলো থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন এবং বনভূমি উজাড় করে পাহাড় ন্যাড়া করাই এর কারণ। মানবসৃষ্ট এই দুর্যোগ পাহাড়ী অধিবাসীদের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে এনেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানবসৃষ্ট এসব কারণের সঙ্গে যোগ হচ্ছে অতিবৃষ্টি। যা পাহাড়ধসকে আরও ত্বরান্বিত করছে। পাহাড়ে অতিবৃষ্টির কারণে মাটির ইন্টারনাল বেয়ারিং ক্যাপাসিটি কমে যাওয়ার ফলে মাটি থেকে মাটি সরে আলাদা হয়ে পাহাড়ের নিম্নের দিকে ধসে পড়ে। বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়ায় মাটির গঠন ও প্রকৃতি নষ্ট হয়ে পড়ছে। ফলে মাটি আলগা হয়ে সামান্য বৃষ্টিতেই ধসে পড়ছে। যার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ সম্প্রতি দেশে বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় ভয়াবহ ভূমিধস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আকতার বলেন, পাহাড়ধস একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও মানুষের অপরিণামদর্শী ও অজ্ঞাতপ্রসূত কর্মকা- পাহাড়ধসকে বেশি ত্বরান্বিত করছে। সাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনাকে মানবিক বিপর্যয়কর দুর্যোগে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করছে। পরিবেশ সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন বলেন, দেশে পাহাড় বিনষ্টের এই ঘটনা গত বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। দীর্ঘদিন থেকে বন উজাড় ও পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়েছে। কিন্তু পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আগে থেকে যদি সতর্ক ও সজাগ থাকত তাহলে কিছুটা হলেও এই বিপর্যয় রোধ করা যেত। এই পাহাড়ধস শুধু অতি বৃষ্টির কারণেই ঘটেনি। দীর্ঘ দিনের পাহাড় কাটা ও বন উজাড়ও এর অন্যতম প্রধান কারণ। অতএব একটি পরিবেশবান্ধব পাহাড় সংরক্ষণ ও ব্যবহার পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিবৃষ্টি ছাড়াও অপরিকল্পিতভাবে বসতি স্থাপন এবং গাছপালা উজাড় করায় হুমকিতে রয়েছে পাহাড়ী এলাকা। অতীতে পাহাড়ধসে এত হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও গত বেশ কয়েক বছর থেকে অপরিকল্পিত বসতি স্থাপন, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের লোকজন, উপকূলীয় ও নদীভাঙ্গা বা বানবাসী লোকজন পাহাড়ী এলাকায় এসে জীবন যাপন করছে। পাহাড়ের চরিত্র বৈশিষ্ট সম্পর্কে তাদের ধারণাও কম। এ বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সচেতনতাও নেই। এছাড়াও একদিকে প্রকল্পের নামে পাহাড় কাটা হচ্ছে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক বা দখল বাণিজ্যেও পাহাড় অনবরত কাটা হচ্ছে। এখন আবার পাহাড় কেটে বসতি স্থাপনের কারণে পাহাড়ধসের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু পাহাড়গুলো পাথরের পাহাড় নয়, এগুলো মূলতঃ মাটির পাহাড় ও বালুময়, তাই এমনিতেই পাহাড়গুলোর ভিত দুর্বল। যেটুকু ভিত রয়েছে তাও আবার নির্বিচারে বন উজার ও পাহাড় কেটে এর ভিতকে নষ্ট করা হয়েছে। যার ফলে আজ এতবড় বিপর্যয় ঘটেছে। পাহাড়ী বন ও পাহাড় সংরক্ষণে বন বিভাগের ব্যর্থতা রয়েছে সর্বজনবিদিত। পরিবেশ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। ফলে প্রতিবছরই দেশে পাহাড় সৃষ্ট বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ভূমিধসপ্রবণ অঞ্চল। দেশের প্রাণঘাতী দুর্যোগগুলোর মধ্যে ভূমিধসকে আশঙ্কাজনক হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিবছরই ভূমিধস কেড়ে নিচ্ছে মানুষের মূল্যবান জীবন ও সম্পদ। তারা বলেন, ভূমিধস প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও দেশে ভূমিধস মূলত মানুষের। ভূমিধসে মূলত ভূমির ব্যাপক উলট পালট হয়ে থাকে। এর ফলে একটি বিস্তৃত এলাকার পাথর গাছপালা ও মাটি ওপর থেকে ধসে পড়তে পারে। আবার অনেক সময় মাটি নিচে দেবেও যেতে পারে। যদিও মধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে ভূমিধস ঘটে। এছাড়াও অনেক কারণ রয়েছে যেগুলো একটি এলাকাকে ভূমিধসপ্রবণ করে তুলতে পারে। ২০১২ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এশিয়ার দেশগুলোর পাহাড়ধস ও বনভূমি শীর্ষক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের পূর্বাঞ্চল, নেপালের তরাই এলাকা এবং বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকার পাহাড়ধসের অন্যতম কারণ বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়া। সেন্টার ফর এ্যানভাইরনমেন্ট এ্যান্ড জিওগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশন সার্ভিসেসের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৩ থেকে ১৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য এলাকার ২৭.৫২ শতাংশ বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় বনভূমি ধ্বংসের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার ৬১ শতাংশ পাহাড়ী ঝরনা শুকিয়ে গেছে। দেশে পাহার কাটার সংস্কৃতি নতুন নয়। পাহাড় কেটে প্রতিবছর গড়ে তোলা হচ্ছে আবাসনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলত কর্মকা-। পরিবেশ আইনে পাহাড় কাটা নিষিদ্ধ হলেও এর বিরুদ্ধে পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে জোরালো কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িতরা রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্ট রয়েছে। ফলে অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু পাহাড় কাটার বলি হচ্ছে নিরীহ মানুষ। দেশে প্রতিবছরই পাহাড় ধসের মতো দুর্ঘটনা ঘটলে এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। ফলে পরিণতি এ বছরও দেড়শজনের প্রাণহানি। এছাড়া সেনাবাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে এবার। তবে পাহাড়ধসের বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে মঙ্গলবার দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অননুমোদিত সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করাসহ আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় একগুচ্ছ প্রস্তাব নেয়া হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাহাড়ধসে যেন আর ক্ষয়ক্ষতি না হয় সেজন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে। অননুমোদিত সব ধরনের পাহাড় কাটা বন্ধ করা, বালি উত্তোলন বন্ধ এবং পাহাড়ী অঞ্চলে চলমান সকল হাউজিং প্রকল্পের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন পাহাড় কেটে নতুন বসতি স্থাপনের ফলেই পাহাড় ন্যাড়া হতে শুরু করেছে। এখন আমাদের যে পরিকল্পনা আমরা গাছ লাগাব, প্রচুর পরিমাণে প্রত্যেকটা পাহাড়ের গায়ে গাছ লাগাব। পাহাড়ে গাছ নেই। অপরিকল্পিত কিছু রাস্তাঘাট করা হয়েছে। সব কিছু মিলিয়েই এই কাজটা হয়ে গেছে। আমরা পরিকল্পনামাফিক এটা করতে চাই। সাগরে নিম্নচাপের কারণে দেশের উপকূলীয় এলাকাসহ পার্বত্য এলাকায় অতি ভারিবর্ষণের ফলে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় ব্যাপক পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এতে দেখা যায় দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে পার্বত্য রাঙ্গমাটিতে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। গত ১২ জুন একদিনেই রাঙ্গামাটিতে বৃষ্টিপাত হয় ৩৪৩ মিলিমিটার। যা ওই এলাকায় রেকর্ড বৃষ্টি। তবে ভারি বৃষ্টিপাত হলেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে যেখানে পাহাড় ন্যাড়া হয়েছে সেখানেই পাহাড়ধসের মতো দুর্যোগ এসেছে। গাছ কেটে ফেলায় টিলা ধসেছে, ভেঙ্গেছে। পাহাড়ধসে প্রাণহানির ঘটনা আগে কখনও দেখা যায়নি। প্রবল বর্ষণে পাহাড়ধসে শুধু রাঙ্গামাটিতেই মারা গেছেন ১১৩ জন। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার মিলিয়ে এই সংখ্যা ১৬০ ছাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের মাঝখানে বা ঢাল কেটে বসতি স্থাপন করলে পাহাড়ধসের মতো দুর্ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না। এত থেকে রক্ষা করতে হলে কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে। এরপরও তাৎক্ষণিক বিপদ এসে গেলে কিছু পন্থা অবলম্বন করার আহ্বান জানান তারা। বলেন, সর্ব প্রথম খেয়াল রাখতে হবে যে বাড়িটিতে বাস করছি সেটি পাহাড়ের ঢালে কিনা? যদি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই আপনাকে অন্যত্র সড়ে যেতে হবে। হঠাৎ দুর্ঘটনার শিকার হলে খাটের নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বৃদ্ধ এবং শিশুদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। বাড়িটি দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকলে নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অথবা পুলিশ প্রশাসনকে জানিয়ে রাখুন। পাহাড় কেটে বসতি স্থাপন বন্ধ করতে হবে। পাহাড়ে গাছপালা কাটা বন্ধ করতে হবে। বেশি বেশি বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। সর্বোপরি পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বৃক্ষ নিধন বন্ধপূর্বক জুম চাষাবাদ বন্ধ করতে হবে।
×