মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি। কিন্তু বর্ষা মৌসুমেও এ পার্বত্য ও পর্যটন এলাকায় ধসের কোন ইতিহাস নেই। এ বিষয়ে জনসচেতনতা বা সতর্কতা নেই বা ছিল না এ এলাকায়। ফলে পাহাড়েই ১৪টি জনগোষ্ঠীর প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষের বসবাস। জেলার সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ বরকল উপজেলায় অবস্থিত, যার উচ্চতা ২ হাজার ৪০৯ ফুট। এদিকে, রাঙ্গামাটি অনেকটা পর্যটকনির্ভর জনজীবন হলেও সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পাহাড়ের মাটি ধসের কারণে ১১৭টি স্পটে সড়ক কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাস্তা মেরামতের পরও আতঙ্ক কাজ করবে পর্যটকদের মধ্যে। ফলে পর্যটকশূন্য কাপ্তাই-রাঙ্গামাটি নৌঘাট। সেই সঙ্গে যেহেতু বাস বা অন্য কোন যান চলাচল বন্ধ রয়েছে, ফলে রাঙ্গামাটি লেকে অলস সময় কাটাচ্ছে নৌযানগুলো।
রাঙ্গামাটি জেলা চারটি প্রধান পর্বতমালাবেষ্টিত। জেলার উত্তরাংশে থাকা উত্তর-দক্ষিণমুখী হাজার ফুট উচ্চতার পাহাড়গুলো এ শহরকে অনেকটা বেড়া দিয়ে রেখেছে। ফলে পর্যটকদের আকর্ষণও এ স্পটকে ঘিরে। জেলার পশ্চিমে ফুরমোন পর্বতমালার উচ্চতা সর্বোচ্চ ১৫১৮ ফুট। এ পর্বতমালা দক্ষিণ-পূর্ব রামগড় পর্বতমালার অনুবৃত্তিক্রম। শহরের পূর্বে রয়েছে দোলা ঝিরি, যা বেশকিছু জলপ্রপাতে ভরা। সর্বোত্তরে রয়েছে মাইনী উপত্যকা। ভূঞাছড়ি রেঞ্জে এ পর্বতমালার উচ্চতা ২ হাজার ৩ ফুট। সর্বোত্তরে বরকল রেঞ্জ পর্যন্ত এ পর্বতমালা বিস্তৃত। শুধু তাই নয়, যার কারণে বরকল রেঞ্জটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়েছে। এর একটি শাখা কর্ণফুলী নদীতে মিশে গেছে। অন্য শাখাটি ভারতের মিজোহিলে মিশেছে।
এ অঞ্চলে সমতল যেমন নেই তেমনি বসবাসও নেই সমতলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের ৩০০ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় সপরিবারে বসবাস রয়েছে পাহাড়ী তথা আদিবাসী ও বাঙালীদের। পাহাড় কাটার কোন অভিযোগ না থাকলেও জুম চাষের মাধ্যমে পাহাড়কে ন্যাড়া করার অভিযোগ রয়েছে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে। তবে এবারের এ প্রাকৃতিক ও আকস্মিক বিপর্যয়ের কারণে শুধুমাত্র শতাধিক মৃত্যুর কারণই হচ্ছে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়া।
এদিকে, গত ১২ জুন রাঙ্গামাটিতে স্মরণকালের রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। রাঙ্গামাটির আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী ১২ জুন ৩৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে পাহাড়ের এঁটেল-দোআঁশ মাটিতে ফাটল সৃষ্টির কারণেই ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছে। এ বিপর্যয়ের কারণে পর্যটকদের মনেও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
রাঙ্গামাটির জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্গত। ফলে প্রকৃতিঘেরা এ অঞ্চলের উষ্ণতা ও আর্দ্রতা পর্যটকবান্ধব। ষড়ঋতুর এ দেশে প্রধানত তিনটি ঋতুই জোরালোভাবে পরিলক্ষিত হয়। বর্ষা মৌসুম সাধারণত মে হতে অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ সময় শতকরা ৯০ ভাগ বৃষ্টিপাত হয়। তবে শীতকাল স্থায়ী হয় নবেম্বর হতে ফেব্রুয়ারি। এ মৌসুম অত্যন্ত শুষ্ক ও শীতল, কখনও সামান্য বৃষ্টি হয়। ফলে পর্যটকদের সর্বোচ্চ চাপ থাকে। পাহাড়, লেক আর ঝুলন্ত সেতুকে ঘিরে এ এলাকার মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের আরেকটি দর্পণ সৃষ্টি হয়েছে এ এলাকায়। এটি হলো রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ।
এদিকে, মার্চ ও এপ্রিল মাসকে গ্রীষ্ম বা প্রাক-বর্ষাকাল বলে গণ্য করা হয়। এ সময় বাতাস খুবই উত্তপ্ত হয় এবং বাতাসে জলীয়বাষ্প খুব কম থাকে। মাঝে মাঝে ‘কালবৈশাখী’ বা শিলাবৃষ্টি হয়ে থাকে। এখানে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে নিম্ন তাপমাত্রা পরিলক্ষিত হয়, যার গড় প্রায় ২০৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এপ্রিল মাসে চরম উষ্ণতা ৩৬৫ ডিগ্রী এবং জানুয়ারি মাসে চরম শীতলতা ১০২ ডিগ্রী সেলসিয়াস হতে পারে।
পর্যটননগরী হিসেবে খ্যাত এ রাঙ্গামাটির উত্তরে রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, দক্ষিণে বান্দরবান, পূর্বে মিজোরাম এবং পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি। এ জেলা আয়তনের দিক থেকে দেশের সর্ববৃহৎ জেলা। দেশের একমাত্র রিক্সাবিহীন শহর রাঙ্গামাটি। হ্রদ পরিবেষ্টিত হওয়ার কারণে পর্যটন শহর এলাকা হিসেবে বিশ্ব সমাদৃত। এ জেলায় চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মুরং, বোম, খুমি, খেয়াং, চাক্, পাংখোয়া, লুসাই, সুজেসাঁওতাল, রাখাইন সর্বোপরি বাঙালীসহ ১৪টি জনগোষ্ঠী বাস করে।
রাঙ্গামাটি আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গেছে, অক্ষরেখার ২২ ডিগ্রী-২৭ ফারহেনাইট ও ২৩ ডিগ্রী-৪৪ ফারহেনাইট উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯১ ডিগ্রী-৫৬ ফারহেনাইট ও ৯২ ডিগ্রী-৩৩ ফারহেনাইট পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে এ শহরের অবস্থান হওয়ায় শীতকালে তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নেমে আসে। এখানে অতিবৃষ্টি যেমন আছে তেমনি অতিশীতও অনুভূত হয়।
রাঙ্গামাটির ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান অঞ্চলকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টির পূর্বের নাম ছিল কার্পাস মহল (১৭১৫-১৮৬০ )। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা থেকে ১৯৮১ সালে বান্দরবান এবং ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি পৃথক জেলা সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার মূল অংশ রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা হিসেবে থেকে যায়। প্রথাগত রাজস্ব আদায় ব্যবস্থায় রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় রয়েছে চাকমা সার্কেল চীফ। চাকমা রাজাই চাকমা সার্কেল চীফ।
ব্রিটিশ আমল থেকে পার্বত্যাঞ্চলে বিদ্যমান বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামোর পাশাপাশি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৭ সালে পার্বত্যচুক্তি স্বাক্ষরের পর নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। পার্বত্যচুক্তির আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী সমন্বয় সাধনের জন্য রাঙ্গামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য একটি টাস্কফোর্সও গঠন করা হয়।
এছাড়াও পার্বত্য এলাকায় ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড, পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং হাট-বাজার ব্যবস্থাপনার জন্য বাজার ফান্ড নামক প্রতিষ্ঠানও গঠন করা হয়েছে। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় জাতীয় সংসদের একটি আসনও রয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় ১০টি উপজেলা, দুটি পৌরসভা ও ৫০টি ইউনিয়ন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ১২টি থানা রয়েছে। এর মধ্যে জনবহুল এলাকায় পড়েছে কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই ও চন্দ্রঘোনা থানা এবং বাঘাইছড়ি উপজেলায় বাঘাইছড়ি ও সাজেক থানা। ১৩৪৭টি গ্রামে লোকসংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ। এর মধ্যে নারী প্রায় ৩ লাখ ও পুরুষ সাড়ে ৩ লাখ।
কাপ্তাই লেককে ঘিরে রয়েছে দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুত কেন্দ্রের ইতিহাস। ৭২৫ বর্গকিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে লেক ছাড়াও উঁচু-নিচু পর্বতশ্রেণী পরিবেষ্টিত রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। পাহাড়গুলো সঙ্কীর্ণ উপত্যকায় ভরপুর এবং হালকা বন ও লতায় ভরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন ৫ হাজার ৯৩ বর্গমাইল বা ১৩ হাজার ১২৮ বর্গকিলোমিটার। এ জেলার উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম, দক্ষিণে বান্দরবান, পূর্বে মিজোরাম ও পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি। এ জেলার প্রধান নদী কর্ণফুলী। এ নদী ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে রাঙ্গামাটির উত্তর-পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ঠেগা নদীর মোহনা হয়ে এ অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। কর্ণফুলীর উপনদীগুলো হলোÑ বড়হরিণা, সলক, রাইনখ্যং কাচালং, চেঙ্গী, ঠেগা ও কাপ্তাই। এ উপনদীগুলো বর্ষাকালে যথেষ্ট খরস্রোতা থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নাব্যসহ পানির পরিমাণ প্রায় থাকে না।