ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেত্রকোনার ঐতিহাসিক রোয়াইলবাড়ি দুর্গ

দুই যুগ পর ফের খননে মিলেছে পাথর টাইলস মৃৎপাত্রের টুকরা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৫ জুন ২০১৭

দুই যুগ পর ফের খননে মিলেছে পাথর টাইলস মৃৎপাত্রের টুকরা

সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে ॥ দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ পর আবারও নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন- রোয়াইলবাড়ি দুর্গের (কোটবাড়ি দুর্গ) খনন শুরু করেছে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদফতর। নতুন এ খনন কাজের মধ্য দিয়ে পাওয়া গেছে তিনস্তর প্রাচীর বিশিষ্ট দুর্গের তোরণ ও গেইটের ধ্বংসাবশেষ, অলঙ্কারিক পাথর (অর্নামেন্টার স্টোন), মুসলিম যুগের টাইলস্, মৃৎপাত্রের টুকরা, লোহা দিয়ে পাথর জোড়া দেয়ার হুকসহ আরও অনেক কিছু। উদ্ধার করা এসব জিনিসপত্র নিয়ে আজ সোমবার দুর্গ এলাকায় মাঠ প্রদর্শনীর আয়োজন করছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। এতে অধিদফতরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন ছাড়াও জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমানসহ স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। জানা গেছে, কেন্দুয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বেতাই নদীর (বর্তমানে মৃতপ্রায়) পাশে রোয়াইলবাড়ি দুর্গের অবস্থান। ১৯৯১ সালে প্রথম দুর্গটি খনন করা হয়। এরপর ১৯৯৪ সাল নাগাদ তিন দফা খননে ৫৩৩.২৩ মিটার (উত্তর-দক্ষিণ) দীর্ঘ ও ৩২৭.৫৭ মিটার (পূর্ব-পশ্চিম) প্রশস্তবিশিষ্ট দুর্গ এলাকাটি চিহ্নিত করাসহ দুর্গের তিনটি পরিখা, সানবাঁধানো ঘাটসহ দুটি বিশাল আকারের দীঘি, বরুজ ঢিবি, বড় দেউড়ি, বার দুয়ারী মসজিদ, মিহরাব, ইটের দেয়ালবেষ্টিত দুর্গ, বহু কক্ষবিশিষ্ট একাধিক ইমারতের চিহ্ন, কবরস্থান ও নিয়ামত বিবির মাজার, লতাপাতা ও ফুল-ফলে আঁকা রঙিন প্রলেপযুক্ত কারুকাজ, পোড়ামাটির অলংকৃত ইট, টালি, জ্যামিতিক মোটিফ, টেরাকোটা, বর্শা, প্রস্থর খ- এবং লোহা ও চিনামাটির নানা জিনিসপত্র আবিষ্কার করা হয়। কিন্তু খনন কাজ তখনও শেষ হয়নি। এরপর প্রায় ২৩ বছর দুর্গটি এক প্রকার অরক্ষিত থাকে। চলতি অর্থবছরের ২১ এপ্রিল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর আবারও দুর্গটিতে খনন শুরু করে। আগামী ১৫ জুন নাগাদ খনন শেষ হবে। অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাহবুব উল আলমের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি টিম খনন কাজ পরিচালনা করছেন। প্রতিদিন ১০-১৫ জন শ্রমিক সেখানে খনন করে চলেছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মাহবুব উল আলম জনকণ্ঠকে জানান, এবারের খনন কাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্গের দক্ষিণ দিকের তোরণ উন্মোচন ও গেইটের বৈশিষ্ট্য জানা। কিন্তু এ দুটির পাশাপাশি আমরা ফুল-লতা-পাতার নক্সা অঙ্কিত অর্নামেন্টাল স্টোন, মুসলিম যুগের টাইলস্, মৃৎপাত্রের টুকরা, লোহায় তৈরি পাথর জোড়া লাগানোর হুকসহ আরও অনেক কিছু পেয়েছি। আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি ১০ কোণাকার ও ১০ বাহুবিশিষ্ট চারটি ওয়াচ টাওয়ার। তিনি জানান, এ ধরনের ওয়াচ টাওয়ার এবং গেইটের বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আর কোন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পাওয়া যায়নি। এটা ব্যতিক্রম। জানা গেছে, স্থানীয়রা এ দুর্গটিকে ঈশাখা নির্মিত দুর্গ হিসেবে জানতেন। কিন্তু গবেষণার বরাত দিয়ে মাহবুব উল আলম জানান, এটি ঠিক কার সময়ে নির্মাণ করা হয়েছিল তা জানা না গেলেও স্থাপত্য শৈলী এবং উদ্ধারকৃত অন্যান্য জিনিসপত্র দেখে আমাদের কাছে মনে হয়েছে- এটি ১৫ শতকের শেষদিকে অর্থাৎ মোঘল আমলের আগে এবং সুলতানী আমলের শেষের দিকে নির্মিত। এ হিসেবে এটি প্রায় ৭শ’ বছরের বছরের পুরনো। ‘রোয়াইল বাড়ি’ নামকরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রোয়াইলবাড়ি’ শব্দটি আরবি এবং বাংলার সমন্বয়ে গঠিত। ‘রোয়াইল’ শব্দটি আরবি ‘রেল’ বা ‘রালাহ’ থেকে এসেছে। যার অর্থ মানুষ অথবা ঘোড়ার অগ্রবর্তী দল বা অশ্বারোহী সৈন্যদল। এছাড়া বাংলায় ‘বাড়ি’ মানে ঘর। কাজেই ‘রোয়াইল বাড়ি’ মানে সৈন্যদলের ঘর বা বাসস্থান। ধারণা করা যায়, এটি সৈন্যবাহিনী বা পদাতিক বাহিনীর আউটপোস্ট ছিল । স্থানীয়রা জানান, ঐতিহাসিক এ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি আজও অনেকটাই অবহেলিত। বিশেষ করে পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো কোন উদ্যোগ এখানে নেয়া হয়নি। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর স্থানীয়ভাবে একজন সাইট পরিচারককে নিয়োগ দিলেও দুর্গটি রক্ষণাবেক্ষণের কোন উদ্যোগ নেয়নি। এর ফলে দিনে দিনে দুর্গের ধ্বংসাবশেষের অনেক কিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অতিথিদের বসার বা থাকার কোন পরিবেশ এখানেই নেই। নেই পানীয় জলের ব্যবস্থাও। এসব কারণে আগন্তুকদের নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় এখানে।
×