ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

আমানতে শুল্ক আরোপ ও সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানোর ঘোষণা ॥ দুশ্চিন্তায় মানুষ

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৪ জুন ২০১৭

আমানতে শুল্ক আরোপ ও সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানোর ঘোষণা ॥ দুশ্চিন্তায় মানুষ

রহিম শেখ ॥ ব্যাংকে রক্ষিত আমানত নিয়ে সাধারণ মানুষকে মহাদুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কেউ ভাবছেন, প্রতি লেনদেনেই কাটা যাবে তাদের টাকা। আবার কেউ ভাবছেন, আমানতে লাভ তো দূরের কথা আসলও পাওয়া যাবে না। সরকারের আয় বাড়াতে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাজেটে ‘আবগারি শুল্ক’ বসানো হয়েছে। এতে আগের চেয়ে অন্তত ১২শ’ কোটি টাকা বেশি আয় করবে সরকার। কিন্তু জনগণ যখন দেখবে তার হিসাব থেকে সরাসরি এত টাকা কেটে নেয়া হচ্ছে, তখন ব্যাংকের সঞ্চয় অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাইবে। এই অর্থের বড় অংশই প্রতারণামূলক কোম্পানির ফাঁদে যাবে। বেশি মুনাফা দেখিয়ে অর্থ আত্মসাত করবে মাল্টিপারপাস কোম্পানি, ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের নামে গ্রাম-গঞ্জে গড়ে উঠা সমিতি ও এনজিও। আর একটা অংশ বিদেশে পাচার হবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকের অর্থ লেনদেনে আবগারি শুল্ক বাড়ানো ঠিক হয়নি। এমনিতে ব্যাংকগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কমে গেছে। এতে করে আমানতকারী প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে জনগণকে ব্যাংকবিমুখ করতে পারে। একটু বেশি লাভের আশায় অনেক ভুঁইফোড় কোম্পানির কাছে টাকা খাটাবে মানুষ। জানা গেছে, আবগারি শুল্ক এক প্রকার পরোক্ষ কর যা দেশজ উৎপাদনের ওপর আদায় করা হয়ে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদিত পণ্য কারখানা থেকে খালাসের সময় এই শুল্ক আদায় করা হয়। বাংলাদেশে আবগারি ও লবণ আইন ১৯৪৪-এর আওতায় আবগারি শুল্ক আদায় করা হয়ে থাকে। জাতীয় সংসদে বিভিন্ন পণ্যের ওপর আরোপণীয় আবগারি শুল্ক হার নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বিধি প্রণয়নের মাধ্যমে আদায়যোগ্য তথা কার্যকর শুল্কহার নিরূপণ করে। বাংলাদেশে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মূল্য সংযোজন কর ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় এবং পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ পণ্যের ওপর আবগারি শুল্ক রহিত করে মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়। বর্তমানে গুটিকয়েক পণ্য ও দেশজ উৎপাদন ও সরবরাহের ওপর আবগারি শুল্ক ধার্য আছে। জানা যায়, ব্যাংকে আমানত অস্বাভাবিক হারে কমছে। মূলত সুদের হার কমায় আমানতকারীরা এখন আর ব্যাংকে টাকা রাখতে উৎসাহী হচ্ছেন না। এছাড়া আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদের হারও কমানো হচ্ছে বলে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়ের বিনিময়ে প্রাপ্ত সুদ মূল্যস্ফীতির হারের চেয়ে বেশি হতে হয়। অন্যথায় টাকার ক্রয়ক্ষমতা কমায় সঞ্চয়কারীকে লোকসান গুনতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদ ৫ দশমিক ১ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরে ব্যাংকে রাখা টাকার ক্রয়ক্ষমতা যতটুকু কমছে সে পরিমাণ সুদও পাচ্ছেন না আমানতকারী। এতে লোকসান হচ্ছে তাদের। এমন অবস্থায় বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট ঘোষণা করেছেন, তাতে ব্যাংকের লেনদেনে নতুন শুল্কের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ব্যাংকের যেসব এ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ডেবিট কিংবা ক্রেডিট হয়, তা পূর্বের মতো আবগারি শুল্ক আরোপ করা হবে না। এখন ১ লাখ টাকার এ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। নতুন সিদ্ধান্তে ১ লাখ টাকার ওপর থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ৮০০ টাকা, এরপর ১ কোটি টাকা পর্যন্ত দেড় হাজারের পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা, ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত সাড়ে ৭ হাজারের পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং ৫ কোটি টাকার উর্ধে যে কোন লেনদেন ১৫ হাজারের পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। জানতে চাইলে সিপিডির রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খানের বলেন, সরকার এ খাত থেকে বছরে প্রায় ১৪শ’ কোটি টাকা আহরণ করে থাকে। নতুন আবগারি শুল্ক বাস্তবায়িত হলে আরও অন্তত ১২শ’ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে আসবে। তিনি আরও বলেন, সরকার আগামী অর্থবছরের জন্য বিশাল একটি বাজেট দিয়েছে। এতে বিশাল ব্যয়ের সঙ্গে আয়টাও অনেক বড়। ব্যাংকে যেহেতু টাকা জমা থাকে, তাই তার ওপর শুল্ক বাড়িয়ে খুব সহজে আয় করা সম্ভব। সরকার এ ক্ষেত্রে সেই উপায়ই বের করেছে। আর্থিক খাত প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় দেশে নগদ লেনদেন বাড়ায় প্রায়ই বিভিন্ন অপরাধ সংঘটনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও অর্থ চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এ বিবেচনায় তিনি নগদ লেনদেন হ্রাস বা নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানান। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ আদান-প্রদানে আবগারি শুল্ক বাড়ায় সে পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হবে না বলে মত দিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, ব্যাংকের অর্থ লেনদেনে আবগারি শুল্ক বাড়ানো ঠিক হয়নি। এমনিতে ব্যাংকগুলো সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। আমানতের সুদহার মূল্যস্ফীতির চেয়ে কমে গেছে। এতে করে আমানতকারী প্রতিবছরই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যা দীর্ঘমেয়াদে জনগণকে ব্যাংকবিমুখ করতে পারে। তিনি আরও বলেন, দেশে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের সুযোগ কম। তাই মানুষ বাধ্য হয়েই ব্যাংকে টাকা রাখে। এখন যদি ব্যাংকে টাকা রেখে আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে ব্যাংকের পরিবর্তে অন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাতে টাকা চলে যেতে পারে। এমনকি পাচারেরও আশঙ্কা রয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, মানুষ ব্যাংকবিমুখ হয়ে পড়বে। এ সুযোগ খুব ভালভাবে ঠককারবারিরা কাজে লাগাতে পারে। তিনি বলেন, ব্যাংকের আমানতে সুদহার মূল্যস্ফীতির সঙ্গে তুলনা করলে খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ রয়েছে। এরপর এমনিতে মুনাফার ওপর ১০-১৫ শতাংশ হারে কর দিতে হচ্ছে। আবার যদি আবগারি শুল্কের হার বাড়ানো হয় তাহলে নিশ্চিতভাবে ব্যাংকে সঞ্চয়ে উৎসাহ হারাবে মানুষ। একটু বেশি লাভের আশায় অনেক ভুঁইফোড় কোম্পানির কাছে টাকা খাটাবে। এতে সঞ্চয়ী মানুষরা সর্বস্ব খোয়াতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আনিস এ খান জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তে ব্যাংক খাতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জনগণ সঞ্চয়বিমুখ হয়ে পড়বে। ফলে ব্যাংকগুলোর ব্যবসাও কমে যাবে। তিনি বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অল্প অল্প টাকা বাঁচিয়ে ব্যাংকে জমা রাখে। এখন যদি তাদের লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়, তাহলে সে টাকা অন্যত্র চলে যাবে। তারা সঞ্চয়ে আগ্রহী হবে না। এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান ও মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোঃ নুরুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংকের আমানতে যে সুদহার রয়েছে, তা মূল্যস্ফীতিজনিত ক্ষয়ের সঙ্গে সমন্বয় করলে প্রকৃতপক্ষে টাকার পরিমাণ বাড়ছে না, উল্টো কমছে। সেই সঙ্গে আবগারি শুল্ক বাড়লে ব্যাংকের প্রতি জনগণ নিরুৎসাহিত হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে একজন আমানতকারী অর্থের ওপর শুল্ক ছাড়াও মুনাফায় কর ও ব্যাংকের চার্জ কেটে নেয়া হয়। এরপর বছর শেষে যদি মূল্যস্ফীতি সামঞ্জস্য করা হয়, তাহলে তার টাকা বাড়ে না বরং কমে যায়।
×