ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ রুখে দিতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১০ মে ২০১৭

ঐক্যবদ্ধভাবে সন্ত্রাস জঙ্গীবাদ রুখে দিতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নির্বিঘেœ নিজেদের ধর্ম পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, আপনাদেরই দেশ, আপনাদেরই মাটি। ধর্ম পালন করবেন, মর্যাদা নিয়ে চলবেন। কাউকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন নয়। আমরা সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে চাই। সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার নিয়ে ধর্ম পালন করবে, মর্যাদা নিয়ে চলবে। মঙ্গলবার গণভবনে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ-মাদকের বিরুদ্ধে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সব অশুভ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুƒখে দিতে হবে। দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। তাই কোন লুটেরা-দুর্নীতিবাজ-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ সৃষ্টিকারীর এই মাটিতে স্থান হবে না। সবাইকে বুদ্ধ পূর্ণিমা উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন, গণভবনের এই মাটি ধন্য সুদূর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এসেছেন, অনেকদূর থেকে সবাই এসেছেন। বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে, এখানে আপনাদেরও অবদান গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের নেয়া নানামাত্রিক পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে বলেন, দেশের মানুষ যতটুকু পাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পরই পাচ্ছে। আমরা যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করেছি, আমরা বিজয়ী জাতি। তাই সবসময় আমরা মাথা উঁচু করেই চলব, এটাই আমাদের লক্ষ্য। সহিংসতার বিরুদ্ধে সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ পুড়িয়ে মারার ঘটনা যেন আর না ঘটে। তিনি বলেন, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। বাংলাদেশে সবাই মিলে উৎসব আয়োজন করি, সব ধর্মের মানুষের মধ্যে ভাতৃত্ব থাকতে হবে। তার সরকার অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এগিয়ে যেতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদেশ আমাদের, মর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে এদেশকে গড়ে তুলতে হবে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা দেশকে গড়ে তুলব। আর সব ধর্মের মূলমন্ত্র একই। সংঘাত, হিংসা, বিদ্বেষ পরিহার করতে এবং মানুষে মানুষে সংঘাত পরিহার করতে বলে গেছেন গৌতম বুদ্ধ। তিনি বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে সকল ধর্মের মানুষ নিরপেক্ষভাবে ধর্ম পালন করবে। সকলের মাঝে সৌহার্দ্য থাকবে। সকলে মিলেই আমরা একটি শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ে তুলব। অনুষ্ঠানে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং, সংঘনায়ক শুদ্ধানন্দ মহাথেরো, উপসংঘ রাজ সত্যপ্রিয় মহাথেরো, পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধভিক্ষু সংস্থার প্রেসিডেন্ট প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরো, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ উত্তম কুমার বড়ুয়া, বৌদ্ধকল্যাণ সংঘের ট্রাস্টি সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি দয়াল কুমার বড়ুয়া। এর আগে বৌদ্ধ ধর্মগুরু এবং সংঘ নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে স্বাগত জানান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকা-ের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে প্রকাশিত একটি ব্রশিয়ারের মোড়ক উন্মোচন করেন। গণভবনের সবুজ লনে সরকারের ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীসহ দেশের ধর্মের মানুষকে দেশের উন্নয়নে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাবার আহবান জানিয়ে বলেন, তার সরকার দেশের সকল ধর্মাবলম্বীর সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য। আর এই লক্ষ্য অর্জনে সকল ধর্মবর্ণগোত্র নির্বিশেষে সকল জনগণকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যেতে হবে। তিনি বলেন, আজকে যারা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এখানে উপস্থিত আছেন তাদের এটুকুই বলব, আপনাদেরই দেশ, আপনাদেরই মাটি- সকলেই সমমর্যাদা নিয়ে ধর্ম পালন যেভাবে করবেন এবং সেই মর্যাদা নিয়েই আবার চলবেন, আমরা সেটাই চাই। দেশের সকল গোষ্ঠীকে উন্নয়নের ধারায় সম্পৃক্ত করার জন্যই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের উন্নয়ন সকলকে নিয়েই, কাউকে বাদ দিয়ে নয়। সকলেরই আমরা ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই। দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধিশালী করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে নিজের হাতে গড়ে তুলেছেন, এ সংগঠনের মাধ্যমেই এ দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিজয়ী জাতি আমরা। আমরা সবসময় এটাই মনে রাখব, বিজয়ী জাতি হিসেবে আমাদের দেশকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব। কারো কাছে হাত পেতে নয়, কারো মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, মর্যাদার সঙ্গে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নে গড়ে তুলব সোনার বাংলাদেশ হিসেবে। শেখ হাসিনা বলেন লুটেরা, দুর্নীতিবাজ যারা সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ সৃষ্টিকারী তাদের এই মাটিতে কোন স্থান হবে না। বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয় তারা শান্তি চায়-শান্তির সঙ্গে বসবাস করবে। সকলেরই আমরা ভাগ্য পরিবর্তন করতে চাই। দেশকে উন্নত সমৃদ্ধিশালী করতে চাই । তিনি বলেন, এদেশের প্রতিটি নাগরিক আস্থার সঙ্গে চলবে, বিশ্বাস নিয়ে চলবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজের আর্থ-সামাজিক উন্নতি করবে। সরকার হিসেবে সবরকম সুযোগ-সুবিধা আমরা করে দেব। এটাই আমাদের লক্ষ্য। আজকে যতটুকু এদেশের মানুষ পাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পরই তারা তা পাচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, এই বাংলাদেশকে আমরা একটি মর্যাদাশীল রাষ্ট্রে উন্নীত করতে চাই। যেটা জাতির পিতার লক্ষ্য ছিল। বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার সুযোগ পাবে। আমরা এটি নিশ্চিত করতেই নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জানি আমাদের এদেশে একেক সময় এক একটা ঝড় আসে, এক একটা তা-ব হয়। যেমন আপনারা দেখেছেন সেই ২০০১ সালের নির্বাচনের পর এখানে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একদিকে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তেমনি সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ নির্যাতিত হয়েছে। নির্বিচারে মানুষ হত্যা, নির্যাতন ও লুটতরাজ চালানো হয়েছে। এ সময় ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের নামে পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার রাজনীতির তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, রাজনীতি আমরা করি জনগণের স্বার্থে, রাজনীতি করি জনগণের কল্যাণে আর সেখানে রাজনীতির নামে বা আন্দোলনের নামে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা। এই ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা যেন বাংলাদেশের মাটিতে আর না ঘটে। সেটাই আমরা চাই। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার পথ খুঁজে বের করুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার পথ খুঁজে বের করতে তার সরকারের বার্তা মিয়ানমার সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে দেশটির বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মিয়ো মিন্ত থানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে সাক্ষাত করতে গেলে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা সমাধানে আমাদের একত্রে একটি পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। প্রতিবেশী হিসেবে আমরা সবসময় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যাটির সমাধান করতে চাই। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, শরণার্থীরা বাংলাদেশে সামাজিক ও পরিবেশগত চাপ সৃষ্টি করছেÑ বাংলাদেশের এ অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশে বহু অনথিভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থী বাস করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা খুবই মানবেতর অবস্থার মধ্যে বসবাস করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে আলোকপাত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণভাবে ভারত থেকে শরণার্থীদের ফেরত এনেছে। প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করতে উভয় দেশের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি দুদেশের যৌথ বাণিজ্য কমিশন ও নৌপরিবহন কার্যক্রম সক্রিয় করার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন। প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাসবাদে তার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমাদের ভূমি প্রতিবেশীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেব না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের মূল্যায়ন করে। সাম্প্রতিক মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে বাংলাদেশে ঠাঁই না দিতে আমরা দৃঢ় অবস্থানে রয়েছি। বিদায়ী রাষ্ট্রদূত বলেন, তার সরকার রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তরিক এবং এ ক্ষেত্রে কফি আনান কমিশনের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নে একমত। তবে এর কিছু সুপারিশ বাস্তবায়ন করা দুরূহ। অবশ্য মিয়ানমার সরকার সমস্যাটির সমাধানে পৌঁছতে আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাতকালে মিয়ানমারের নেতা আউং সান সুচিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সুরাইয়া বেগম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
×