ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মু. মিজানুর রহমান মিজান

একি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশনিসঙ্কেত?

প্রকাশিত: ০৫:৫৭, ৩ মে ২০১৭

একি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের অশনিসঙ্কেত?

১৯৯৩ থেকে নিয়মিত বিরতিতে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার গল্প বিশ্বের কাছে অজানা নয়। কিন্তু ২০১৫-এর পর যেন তাদের গতি অনেকাংশে বেড়ে যায়। সম্প্রতি দুই সপ্তাহ না গড়াতেই দুবার এ পরীক্ষা চালিয়েছে দেশটি, এর ঠিক পূর্বে সামরিক প্যারেডেরও আয়োজন করে বিশ্বমিডিয়ায় নতুন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তবে ব্যর্থ হয়েছে দুটো পরীক্ষাই। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবারই এর বিরোধিতা করে আসছে; সঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপানও। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধভাবে উত্তর কোরিয়ার রাঙ্গা চোখও দেখতে হয়েছে। মূলত যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর মন্তব্য করতেই দেখা যাচ্ছে সবাইকে। উত্তর কোরিয়া বিশ্ব পরিবেশের স্বাভাবিকতা নষ্ট করতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রও তার বিপরীতে উপযুক্ত জবাব দেবে, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে না এমন হুঁশিয়ারি পয়লা থেকেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মাত্র কয়েকদিন আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, উত্তর কোরিয়াতে আচমকা হামলা চালাবেন যেমনটি করা হয়েছে সিরিয়াতে। জাতিসঙ্ঘেরও অনেক আগ থেকেই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে দেশটির এই কার্যক্রমে তবে উত্তর কোরিয়া বরাবরই বলছে, এগুলো শুধুই তাদের প্রতিরক্ষামূলক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্যই, কারও ক্ষতি হোক এমনটা চান না বা উদ্দেশ্যও নয়। যুক্তরাষ্ট্রকে উসকানিমূলক সিদ্ধান্ত না নেয়ার জন্য সতর্ক করে উত্তর কোরিয়ার সুপ্রিম লিডার কিম জং-উন বলেছেন, তারা পরমাণু হামলা চালাতে প্রস্তুত রয়েছেন। দেশটির পলিসি ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান চো রেয়ং-হায়েও এ রকমটাই বলেছেন, যে কোন পরমাণু হামলার বিপরীতে তারা তাদের নিজস্ব সিস্টেমে পাল্টা পরমাণু আঘাত করতে প্রস্তুত। এসব বিষয় নিয়ে পরমাণুতে বলীয়ান দেশটি এমন সময় মুখ খুলল যখন বিশ্ব মিডিয়া তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং ট্রাম্পও নৌবহর পাঠানোর পরিকল্পনা করছেন দক্ষিণ কোরিয়া উপদ্বীপে। এ দ্বীপে অবশ্য এই মুহূর্তে নৌবহর অবস্থান নিয়েছে। মাঝখান থেকে উত্তর কোরিয়ার মিত্রদেশ বলে পরিচিত চীন এক বিবৃতিতে বলে, উত্তর কোরিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়ে পরলে কোন পক্ষই জয়ী হবে না। তা হলে কী তারা কোন সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে না কি দুপক্ষকে যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে সতর্ক করেছে? দক্ষিণ কোরিয়ার সিওল থেকে একজন সাংবাদিক ১ম ব্যর্থতার পর বলেন, ব্যর্থ পরীক্ষাটি থেকে এটাই বোঝায়- পিয়ংইয়ংয়ের বিশাল সামরিক প্যারেড এবং সারি সারি ক্ষেপণাস্ত্রের অর্থ এই নয় যে, তাদের কাছে একটি কার্যকর পারমাণবিক অস্ত্রের বহর রয়েছে এবং সফলতার হার আগের চেয়ে বাড়লেও লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করার মতো যথেষ্ট সফল এখনও হতে পারেনি (বিবিসি অনলাইন)। এর আগে ১৮ এপ্রিল উত্তর কোরিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী হ্যান সাং রিওল জানিয়ে রেখেছেন, ‘যদি বুঝতে পারি যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা হলে, তা ঠেকাতে প্রয়োজনে নিজেরাই পরমাণু হামলা করব। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র আমাদের ওপর সামরিক অভিযানের কোন পরিকল্পনাও করে তাহলে উত্তর কোরিয়া নিজস্ব স্টাইলে আক্রান্ত হবার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর পরমাণু হামলা চালাব।’ পাশাপাশি পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষা চালানো থেকে বিরত থাকবে না বরং সাপ্তাহিক, মাসিক ও বাৎসরিক ভিত্তিতে এটি চলতেই থাকবে, এও জানিয়েছেন সাং রিওল। ইউএস সেক্রেটারি অব স্টেট রেক্স টিলারসন এশিয়া সফরে জানিয়ে গেছেন, যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার সবদিক বিবেচনায় রাখছে এবং রাষ্ট্রীয় মদদে সন্ত্রাসবাদের দিকেও খেয়াল রাখছে পাশাপাশি পিয়ংইয়ংয়ের ওপর কিভাবে চাপ প্রয়োগ করা যায় তাও দেখছেন। কৌশলগত ধৈর্য ধারণের সময় শেষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধজাহাজ ইউএসএস কার্ল ভিন্সন কোরিয় উপদ্বীপে পাঠানোর নির্দেশ দেন, যথাসময়ে তা পৌঁছেছেও; সঙ্গে যোগ দিয়েছে ইউএসএস মিশিগান নামে একটি সাবমেরিন, চলছে অস্ত্রের মহড়া। অনেকের কপালেই এ নিয়ে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে গেছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন দল ওয়ার্কার্স পার্টির প্রধান পত্রিকা ‘রদং সিনমুন’এ বলা হয় হয়- ‘আমাদের বিপ্লবী বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার চালিত বিমানবাহী রণতরীকে মাত্র একটি আঘাতেই ডুবিয়ে দিতে সক্ষম, একটি নোংরা যন্তুকে আক্রমণের মধ্য দিয়ে উত্তর কোরিয়ার সামরিক শক্তির একটি বাস্তব উদাহরণ দেখানো যাবে।’ দেশটির রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘মিঞ্জু’ বলে ‘এমন নির্দয়ভাবে হামলা করা হবে যে, তারা আর প্রাণ ফিরে পাবে না।’ উত্তর কোরিয়া নিজেদের সেনাবাহিনীর ৮৫তম বার্ষিকীও পালন করেছে আসলগুলো ব্যবহার করে লড়াই মহড়ার মাধ্যমে। খবর ভাসছে, চীনও বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে চলমান উৎকণ্ঠার বিপরীতে। কে জানে পরিস্থিতি কোথায় যাচ্ছে? ২৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে হুমকি দিলে ২৮ এপ্রিল পুনরায় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। তবে সবকিছু ছাপিয়েও এখন বড় খবর হচ্ছে- আমেরিকার সিবিএস টিভিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিম জং-উন সম্পর্কে বলেন, ‘তাঁর বাবা মারা যাবার পর মাত্র ২৬ কি ২৭ বছর বয়সে ক্ষমতায় বসেন। এবং খুব কম বয়সে ক্ষমতায় বসায় অনেকেই ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে, আমি নিশ্চিত; এতে তাঁর চাচা কিংবা অন্য কেউ ছিল কিন্তু তিনি সেটা ধরে রেখেছেন। সে হিসেবে সে বেশ বুদ্ধিমান (ঢ়ৎবঃঃু ংসধৎঃ পড়ড়শরব)।’ ‘ফেস দ্য নেশন’ নামের প্রোগ্রামটিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১০০ দিন পূরণ উপলক্ষে দেয়া সাক্ষাতকারে ২য় ব্যর্থ পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘আমাদের সব পদক্ষেপ সম্পর্কে ঘোষণা দেয়া ঠিক হবে না, এটি একটি দাবা খেলা। আমি আসলে আমার ভাবনাটা মানুষকে জানাতে চাই না।’ এসব যদি পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধের প্রাক-আলামত হিসেবে ধরলে কি ভুল হবে? ১৯১৪ সালে বসনিয়ার রাজধানী সার্বিয়ায় অস্ট্রিয়ার যুবরাজ এক সার্বিয়ানের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন। এতে অস্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং যুদ্ধ ঘোষণা করে। ধীরে ধীরে দুই দেশের বন্ধু দেশগুলোও যুদ্ধে জড়ায়। এ রকম করেই ১ম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল। তবে ওই হত্যাকা ই একমাত্র কারণ ছিল না এর পেছনে, শিল্প বিপ্লব ও উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতার রেশ ছিল যা একটি তুচ্ছ ঘটনার ভেতর দিয়ে নিজেদের প্রতিহিংসার জানান দিয়েছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হিসেবে স্পষ্ট কোন ধারণা এখন কেউ দিতে পারেনি, যে যা বলছে সব নিজস্ব অনুমান থেকে বলছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, প্রতিহিংসা ছিল এ যুদ্ধেরও অন্যতম একটি কারণ। চলমান বাগযুদ্ধ, প্রতিহিংসা, আত্মপ্রতিষ্ঠার মোহ নিয়ে বৈশ্বিক যে উৎকণ্ঠা তাতে ভয়ঙ্কর অশুভ কিছু রয়েছে তা মোটামুটি স্পষ্ট। বিশ্বযুদ্ধের মতো কোন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কিনা সে নিয়ে একটি সংশয় থেকেই যায়। তবে ট্রাম্প হয়ত চাইছেন ব্যাপারটি সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে আর তরুণ নেতা কিম চাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের মোড়লগিরির অবসান ঘতাতে। বিবিসির একটি রিপোর্টের ধারণা, দু দেশের যুদ্ধ বেঁধে গেলে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষের প্রাণ যাবে। ওদিকে তেঁতে রয়েছে ইরান ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোও। সূত্র : বিবিসি ও সিবিএস নিউজ
×