ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ব্রেক্সিটের প্রভাব পড়বে না ॥ ক্যামেরন

কার্গো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভূমিকা রাখুন ॥ ডেভিড ক্যামেরনকে প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৮ এপ্রিল ২০১৭

কার্গো নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ভূমিকা রাখুন ॥ ডেভিড ক্যামেরনকে প্রধানমন্ত্রী

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্য বেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি যুক্তরাজ্যে কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ডেভিড ক্যামেরনের কাছে তুলে ধরে এর সমাধানের ওপর গুরত্ব আরোপ করেছেন। এদিকে অপর এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় ডেভিড ক্যামেরন বর্তমান বিশ্বের তিনটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে মানসম্মত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি প্রতিরোধ ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলাকে উল্লেখ করেছেন। ডেভিড ক্যামেরন বৃহস্পতিবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাত করেছেন। এছাড়া তিনি ব্রিটিশ সরকারের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ডিএফআইডির সহায়তায় পরিচালিত একটি প্রকল্প পরিদর্শন করেন। বিকেলে ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার আয়োজিত এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তব্য রাখেন। গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রেস সচিব জানান, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন দৃঢ় আশা প্রকাশ করে বলেছেন, যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অব্যাহত বিকশিত হবে। ব্রেক্সিটের কারণে এ সম্পর্কে কোন পরিবর্তন হবে না। তিনি বলেন, দু’দেশের মধ্যে বিকাশমান সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে এবং এ সম্পর্ক অব্যাহত বৃদ্ধি পাবে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সময় বাংলাদেশ থেকে সরাসরি যুক্তরাজ্যে কার্গো পরিবহনে নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তুলে ধরে এর সমাধানের ওপর গুরত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের ওই নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের বেসরকারী খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ক্যামেরন আশ্বস্ত করেন যে বাংলাদেশের ওপর থেকে কার্গো বিমানের নিষেধাজ্ঞা সমস্যা শীঘ্রই সমাধান হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্যামেরন বলেন, ব্রিটিশ উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে বাংলাদেশে আসছেন। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশী শ্রমিকদের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, পরিকল্পনা ও উদ্যোক্তা বিষয়ে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিরাট অবদান রয়েছে। ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের দ্রুত উন্নয়নে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়ে তার দলের প্রণীত নীতিমালা বর্তমান সরকার বাস্তবায়ন করছে। তিনি কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, নারীর ক্ষমতায়ন ও ডিজিটাইজেশনে সরকারের অসামান্য সাফল্যের উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার আরও শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে দেশব্যাপী এক শ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে এবং এসব অঞ্চলে বিদ্যুত ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজ চলছে। ব্যবসা-বাণিজ্য জোরদারে সরকার গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আমরা দেশব্যাপী রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করছি এবং দক্ষিণ অঞ্চলে রেললাইন নির্মাণে আমরা ব্রিটিশ কোম্পানিকে নিয়োগ দিয়েছি। বৈঠকে ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়। রোহিঙ্গা ইস্যু সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে মিয়ানমারের ৪ লাখ নাগরিককে আশ্রয় দেয়া অত্যন্ত কঠিন। মিয়ানমার যদি তাদের নাগরিকদের এখান থেকে ফিরিয়ে নেয় সেটিই হবে সবচেয়ে উত্তম। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ সংযোগ স্থাপন জোরদারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তিনি বিবিআইএন এবং বিসিআইএম-ইসি উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব সুরাইয়া বেগম এবং ঢাকায় যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার এ্যালিসন ব্লেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। ডেভিড ক্যামেরনের একক বক্তৃতা যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, কেবল নির্বাচন নয় মানসম্পন্ন গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখাই এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানে ফোর পয়েন্ট হোটেলে ঢাকা সফররত ব্রিটিশ এই রাজনীতিক ব্রিটিশ বাংলাদেশ চেম্বার আয়োজিত এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন। ‘বিশ্বের এই বর্তমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ’- শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি মোটাদাগে তিনটি চ্যালেঞ্জকে চিহ্নিত করেন। প্রথমত মানসম্পন্ন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয়ত দুর্নীতি প্রতিরোধ, বিশেষত রাজনীতিকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা। তৃতীয় এবং সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ হলো ইসলামের নামে চরম পন্থা ও জঙ্গীবাদের উত্থান। এটাকে আদর্শিক সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। ডেভিড ক্যামেরন বলেন, ব্রিটেনে প্রায় ৩০ লাখ বাংলাদেশী বাস করে। তারা ব্রিটেনের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বিশাল প্রভাব বিস্তার করে আছে। বক্তৃতায় ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নানাক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই বক্তৃতা অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বক্তৃতার সমাপনীতে অনুষ্ঠিত প্রশ্নত্তোর পর্বে ডেভিড ক্যামেরন সুধীজনের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সেখানে তিনি তার দৃষ্টিতে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলোর ব্যাখ্যাও দেন। পোশাক কারখানা পরিদর্শন রাজধানীর তেজগাঁওয়ের একটি পোশাক কারখানা পরিদর্শন করেছেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। সেখানে ডিএফএআইডির সহায়তায় দক্ষকর্মী তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই সময় ডেভিড ক্যামেরন পোশাক শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করেন। একই সঙ্গে পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বুধবার রাত ১১টার দিকে ঢাকায় পৌঁছেন। একটি বেসরকারী সংস্থার আমন্ত্রণে তিনি প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসেন তিনি। ঢাকা সফরকালে বৃহস্পতিবার তিনি খুব ব্যস্ত সময় পার করেছেন। প্রায় ২৪ ঘণ্টারও কম সময় তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন। বৃহস্পতিবার রাতে ডেভিড ক্যামেরন ঢাকা ত্যাগ করেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কখনই বাংলাদেশ সফর করেননি ক্যামেরন। এটা তার প্রথম বাংলাদেশ সফর। গত বছরের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের পক্ষে রায় যাওয়ার পর পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। তিনি ও তার দল যুক্তরাজ্যের ইইউয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন। পরে ভোটের ফলাফল তার পক্ষে না আসায় তিনি নৈতিক পরাজয় মেনে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরে তার স্থলাভিষিক্ত হন টেরেসা মে। এর আগে গত বছর মে মাসে জাপানে জি-৭ আউটরিচ প্রোগ্রামে ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ইইউ থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া ব্রেক্সিটের বিপক্ষে বাংলাদেশের অবস্থানের কথা জানিয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের একটি অংশ ব্রেক্সিট সমর্থন করার প্রেক্ষাপটে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা হয়। এছাড়া ২০১৪ সালের জুলাই মাসে গার্ল সামিটে অংশগ্রহণের সময় লন্ডনে শেখ হাসিনা-ডেভিড ক্যামেরনের মধ্যে এক বৈঠক হয়।
×