ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সব্যসাচী দাশ

ভালবেসে চলে যেতে নেই...

প্রকাশিত: ০৭:১২, ২৭ এপ্রিল ২০১৭

ভালবেসে চলে যেতে নেই...

মেঘের গুড়ু গুড়ু ডাক। দিনের বেলা সন্ধ্যা নামিয়েছে অন্ধকারাছন্ন মেঘ। অতঃপর নগর ভাসিয়ে, গ্রাম ডুবিয়ে বানের জলের মতো বইছে বৃষ্টির জলপ্রপাত। বৈশাখের প্রথম প্রহর থেকেই প্রকৃতির এমন বৈরী আচরণ। এসবের উদ্দেশ্য জানা ছিল না। তবে এখন বেশ পরিষ্কার। প্রকৃতির মতো শান্ত-শিষ্ট নিভৃতচারী এক মানব সন্তানকে কাছে টানার জন্যই হয়ত এমন ব্যাকুল বৈরী আচরণ! প্রকৃতি আলিঙ্গন করতে চায় তার অনাদরের সন্তানের সঙ্গে! তাই তো এই রাগ-ঢাকের দামামা! তা না হলে ২০১৫ সালে যখন জানা গেল মরণ রোগ ক্যান্সার তার ফুসফুস দখল করে নিয়েছে। নিস্তারমেলা দুষ্কর। তার পরও চেষ্টার কোন কমতি ছিল না। অল্প ক’জনের আবেগ-অনুরাগে। সব শেষ খবরের কাগজে নিউজ আসে আগের থেকে তার শারীরিক অবস্থা ভাল, স্বাভাবিক কথা বলছেন, সবার খোঁজখবর নিচ্ছেন। নিজের বাড়ি আরমানিটোলা থেকে মেয়ের সঙ্গে তোলা ছবিও ছাপা হয়েছে। ২০ এপ্রিল শুক্রবার বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা। মেঘ-বৃষ্টির দোলাচলে প্রকৃতি দুলছে, এমনি অশোভন ক্ষণে হারিয়ে গেল আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের ধ্রব তারা লাকী আখন্দ। মুহূর্তেই খবর হলো চরাচর। জন্ম কবে। সঙ্গীতের প্রথম হতে খড়ি কবে। কবে কোন্ সাফল্যের স্বীকৃতি। শোকবার্তা ভূরি ভূরি। এই তো অনাদরের অন্তিম আখ্যান। না! লাকী আখন্দের ক্ষেত্রে অন্তিম বলে কোন শব্দ প্রযোজ্য নয়। তিনি আজ ও আগামীর। সঙ্গীত শব্দটিই তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কেনই বা রাখবে না। তিনি তো সৃষ্টি করেছেন বেঁচে থাকার অমর গান। প্রায় দেড়টা হাজার গানের জন্মের ধাত্রী তিনি। ওই সহস্র গানই তাকে ধারণ করবে। দুঃখের মতো এত বড় পরশ পাথর আর নেই। হয়ত এই প্রবাদের শীতল পরশে লাকী আখন্দ গেয়েছেন শত শত হৃদয় শীতল করা গান। জীবনের প্রথম ভাগে একাধিক ব্যক্তিগত সঙ্কট লাকী আখন্দের সঙ্গে ছোট ভাই হ্যাপীর জীবন দর্শন বদলে দেয়। গীটারের তার আর সুর সৃষ্টির নেশা দুই ভাইকে মিউজিকের দুনিয়ায় ফেরারি খেতাব দেয়। বলতে গেলে জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই লাকী তার হৃদয়ে সুরের ঝর্ণা ধারা অনুভব করেছেন। তার বাবা ছিলেন সেই ঝর্ণা ধারার গতিপ্রবাহক। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সঙ্গীতে তার অসামান্য নৈপুণ্য তৎকালীন অন্ধকার পাকিস্তানে আলোর দ্যুতি ছড়িয়েছে। সঙ্গীতের অভয়ারণ্য ভারত ভূমিতেও ছিল তার উজ্জ্বল বিচরণ। স্বাধীন বাংলা বেতারের হয়ে করেছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন। সঙ্গীতকে যতখানি অন্তরাত্মায় ধারণ করতেন ততটাই মাতৃভূমিকে। যে কারণে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানীদের নারকীয় কর্মযজ্ঞের প্রতিবাদে এই শান্ত মানুষটি দুরন্ত প্রতিবাদ করেন। যোগ দেন জাতির মহান কর্ম মুক্তিযুদ্ধে। দেশ স্বাধীন হলো। যুগল বিহঙ্গের মতো লাকী-হ্যাপী উড়ে উড়ে গান করছে স্বাধীন দেশের বুকেজুরে। সত্তর থেকে আশির দশক জাতির হাজারটা সমস্যার মধ্যে হাজারটা গান সৃষ্টি করছেন। মিটিয়েছেন সুরের তৃষ্ণা! ১৯৮৭ সাল। লাকীর বুকে ভাই হ্যাপীকে হারানোর বিষাদের কালো চাদর। হ্যাপী মারা গেলেন বিষের নীল দংশনে। সঙ্গীতের সহযাত্রী প্রিয় ভাইকে হারিয়ে মন আর তার বসল না সঙ্গীতে। অবশেষে লাকী ফিরলেন তার অস্তিত্বের কিনারে। ১৯৯৮ সালে বিতৃষ্ণা জীবনে আমার এ্যালবামের মাধ্যমে। আবারও সঙ্গীতের সঙ্গে তার পথচলা, তবে এ যাত্রার গতি ছিল ধীর। গত ২১ এপ্রিল সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হয়ে ইহজাগতিক সকল মায়া কাটিয়ে পারি জমান শূন্যলোকে। মৃত্যুভয় কখন এই নিভৃতচারীকে স্পর্শ করেনি। অসুস্থ অবস্থায় এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন মৃত্যুভয়ে আমি কখনই ভীত নই। মৃত্যুভয় জয় করেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম। হ্যাঁ। লাকী আখন্দের শারীরিক মৃত্যু ঘটেছে। কিন্তু তার সৃষ্টির মৃত্যু সম্ভব নয়, তিনি বেঁচে থাকবেন তার গাওয়া গানে। তার তোলা সুরে। আমাদের মতো সঙ্গীত খরার দেশে লাকী আখন্দ সুরের সোনালি বীজ বপন করেছেন। তৈরি করেছেন একাধিক জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী। তাদের দিয়ে গাইয়েছেন নিজস্ব আধুনিক গান। যে গান বহুকাল বাজবে অগণিতের অন্তরে। লাকী আখন্দের গান তার প্রস্থান উপলক্ষে যখন লেখা তখন গান তো অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। শুরুতেই এই নীলমণি হার/ এই স্বর্ণালি দিনে তোমায় দিয়ে গেলাম/ শুধু মনে রেখ... বোঝায় যাচ্ছে সুরের যে মণিহার তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন তা অবশ্যই আমরা আমাদের মণিকোঠায় তুলে রাখব। আমায় ডেকো না ফেরানো যাবে না/ ফেরারি পাখিরা কুলায় ফেরে না শত ডাকলেও লাকী আখন্দের দেহ আর সাড়া দেবে না। তবে এই গানের মাধ্যমে তাকে ফিরে পাওয়া যাবে। যেখানে সীমান্ত তোমার/ সে খানে বসন্ত আমার/ ভালবাসা হৃদয়ে নিয়ে/ আমি বারে বার আসি ফিরে এই গানের মধ্যে তিনি অবশ্যই বারে বারে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে/ জোনাকীর আলো জ্বলে আর নেভে আর/ শাল মহুয়ার বনে। হয়তো কোন গভীর রাতে জোনাকীর ঝাঁক জ্বলে-নিভে তাকেই স্মরণ করবে। তিনি আমাদের তার তোলা সুরে শুনিয়েছেন চলো না ঘুরে আসি অজানাতে/ যেখানে নদী এসে থেমে গেছে এমন মোহনীয় অজানার ঠিকানা এর আর আগে কেউ আমাদের দেয়নি। এমন শত শত গান রয়েছে সেগুলোর এক লাইন করে উল্লেখ করলে লেখার দৈর্ঘ্য হবে দীর্ঘ। লেখা দীর্ঘ না করে তার স্মৃতি দীর্ঘ করাই শ্রেয়। আমরা এই বিনয়ী গানওয়ালার দীর্ঘ জীবন কামনা করি। সঙ্গে বিষাদে স্মরণ করি লিখতে পারি না কোন গান আজ তুমি ছাড়া...
×