ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

তলিয়ে গেছে হাওড়ের দুই লাখ হেক্টর জমির ফসল

সুনামগঞ্জে টানা বর্ষণ, আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৮ এপ্রিল ২০১৭

সুনামগঞ্জে টানা বর্ষণ, আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

এমরানুল হক চৌধুরী, সুনামগঞ্জ থেকে ॥ দেড় সপ্তাহের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে বাঁধ ভেঙ্গে হাওড়ের এক লাখ এক হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অবশিষ্ট যে ফসল রয়েছে তাও পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারী হিসেব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদিত হয়। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালকের কর্যালয় সূত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এদিকে হাওড় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বোরো ফসল ডুবে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ডুবে যাওয়া ফসলের পরিমাণ হবে প্রায় দুই লাখ হেক্টর। এমনই মতামত দিলেন তারা। কৃষি বিভাগ ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে লুকোচুরি করছে বলে অভিযোগ করে ‘হাওড় বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’র সদস্য সচিব বিন্দু তালুকদার বললেন, হাওড়ের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যে ফারাক রয়েছে। জানা যায়, গত ১০ দিনের টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলার মধ্যে জামালগঞ্জসহ ১০টি উপজেলার প্রায় সবক’টি বড় হাওরের ফসল ডুবে গেলেও শাল্লার বাঁধগুলো টলটলায়মান অবস্থা। ছায়ার হাওড়ের বাঘরাধরা বাঁধ রক্ষার জন্য প্রায় ৫ হাজার কৃষক লড়াই করছে। বাঘরাধরা বাঁধের ৩ কিলোমিটার জুড়ে স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কাটছেন কৃষক। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাল্লার ভা-া বাঁধ উপচে পানি ঢুকতে শুরু করেছে। কালনী নদীর পানি কূল উপচে দিরাইয়ের বরাম হাওড়ের তুফানখালি বাঁধ ভেঙ্গে জয়পুরের মরা নদীর দুটি বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। এই অবস্থায় শাল্লা উপজেলার শিবপুর, কল্যাণপুর, কৃষ্ণপুর, মামুদনগর, অজয়কান্দা, শশারকান্দা, উজানগাঁও, নলুয়ারগাঁও, নিয়ামতপুর, আনন্দপুর, নোয়াগাঁও, টরগাঁও, আঙ্গাউড়া, সুখলাইন, ও শান্তিপুর গ্রামের উৎকণ্ঠিত মানুষ শুক্রবার পর্যন্ত স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, অন্যান্য উপজেলা বাদেও জামালগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার মানুষের দুর্ভোগের যেন সীমা নেই। অথচ স্থানীয় প্রশাসন সেদিকে তেমন নজর দিচ্ছে না। কোন সাহায্য-সহযোগিতা না পাওয়ার ফলে এই উপজেলার অনেকের আজ পথে বসার উপক্রম হয়েছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের পূর্ব বীরগাঁও ইউনিয়নের বৃহস্পতিবার ভোর থেকে বাঁধ ভেঙ্গে শালদিঘার হাওড়ে এবং বিকেল থেকে খাইহাওড় বেড়িবাঁধ উপচে হাওড়ে পানি ঢুকছে। দক্ষিণ সুনামগঞ্জের শালদিঘা হাওরের লেউনীভাঙ্গা বাঁধ ভেঙ্গে পাখিমারা, সঙ্কাই হাওড়, পাগলার নাগডরা, খালডড়া, পিঁপড়াকান্দি, দক্ষিণের হাওড়ের, খাইবিলসহ ছোটবড় আরও ৮টি হাওড় তলিয়ে যায় নতুন করে। নলুয়ার হাওড়ের কৃষক খছরু মিয়া বলেন, ফসলহানি হয়েছে সময় মতো বাঁধে মাটি না পড়ায়। সময় মতো বাঁধে মাটি পড়লে ফসলহানি এড়ানো যেত। এ বছর আগাম বৃষ্টি ও ঢল নামায় কাঁচা ফসল তলিয়ে যাওয়ায় ফসল হারিয়ে বিলাপ করছে হাওড়পাড়ের হাজার হাজার কৃষক। পরিবারের লোকজনের পাশাপাশি গবাদিপশুর আহার নিয়েও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন তিনি। প্রতিবাদে উত্তাল সুনামগঞ্জবাসী ॥ জেলার বিভিন্ন স্থানে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে প্রতিটি উপজেলায় চলছে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ, ঘেরাও কর্মসূচী, মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচী। জেলার প্রায় সব কয়টি হাওড় ডুবে যাওয়ায় উৎকণ্ঠিত সুনামগঞ্জের ২৫ লাখ মানুষ। এদিকে ‘হাওড় বাঁচাও, সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ আগামী ১৩ এপ্রিল বেলা ১১টায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে প্রতিটি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের নিয়ে সভা-সমাবেশসহ ক্ষতিপূরণের দাবিতে বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ কর্মসূচী পালন অব্যাহত রয়েছে। শুক্রবার সদর উপজেলার নীলপুর বাজার, টুকেরবাজার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার শান্তিগঞ্জ বাজার, দোয়ারাবাজার উপজেলার আমবাড়ি বাজর জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনাবাজারসহ বিভিন্ন বড় বড় হাটবাজরে প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষাণার দাবিতে। মানববন্ধন, সাংবাদিক সম্মেলনসহ নানা কর্মসূচী চলছে জেলা জুড়ে। শাল্লা উপজেলার কৃষক নেতা বিশ্বজিৎ চৌধুরী নান্টু বললেন, হাজার হাজার কৃষক ছায়ার হাওড় রক্ষা বাঁধে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করলেও পাউবোর কেউ বাঁধে নেই। নেই কোন ঠিকাদর বা তাদের লোকজন। শাল্লা উপজেলার বাহারা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যন প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ফতেমা বেগম বলেন, বরাদ্দের টাকা সময়মত পেলে আমাদের কাজ করতে অনেক সহজ হতো। আমরা সুদে টাকা এনে কাজ করাই। শেষ সময় আমরা এলাকাবাসীর সবার সহযেগিতায় বাঁধ টিকাতে পেরেছি। বরাদ্দের টাকায় সঠিকভাবে কাজ করলে বাঁধ রক্ষা করা সম্ভব বলেও জানান তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য ॥ সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে জেলায় ২ লাখ ১৫ হাজার ৮১৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হলেও ফলন হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য ॥ পানি উন্নয়ন বোর্ডসূত্রে জানা যায়, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে পাউবো’র ৪৮টি হাওড়ের বোরো ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ মেরামত, সংস্কার ও নতুন বাঁধ নির্মাণে ৫৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছিল। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর কাজ শুরুর কথা থাকলেও কাজ শুরু হয়েছিল এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। ফলে এখনও বাঁধের কাজ শেষ হয়নি। কোন কোন বাঁধে পানি আসা পর্যন্ত মাটি ফেলাও হয়নি স্বীকার করে নির্বাহী প্রকৌশলী দরপত্রের শর্ত মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বললেন। চালের বাজার অস্থির ॥ গত কয়েকদিন ধরে হঠাৎ করে সুনামগঞ্জের চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে। হাওড়ের একমাত্র বোরো ফসল তলিয়ে যাওয়ায় যখন কৃষকরা দিশেহারা ঠিক তখনই মিলাররা চাল বাজারে ছাড়া বন্ধ করে দিয়ে চালের বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এ ঘটনায় বাজার মনিটরিং জোরালো করাসহ দোষীদের শাস্তির দাবি জানান হাওড়াঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা।
×