ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুধের ঘাটতি ৭৪ লাখ টন;###;ডিমের ঘাটতি ৪৮৩ কোটি পিস;###;মাংসের ঘাটতি ৯ লাখ টন

দুধ, ডিম ও মাংসের দাম নাগালের বাইরে

প্রকাশিত: ০৩:২৮, ২৭ মার্চ ২০১৭

দুধ, ডিম ও মাংসের দাম নাগালের বাইরে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশে দুধ, ডিম ও মাংস সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে না উৎপাদন, তাই বেড়েই চলছে ডিম, দুধ ও মাংসের দাম। এতে দেশের একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা মিটছে না। পুষ্টির যোগানের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ খাবারগুলো তাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রাণিসম্পদের পোল্ট্রি খাতে যতটা বিকাশ হচ্ছে, পশুসম্পদের ক্ষেত্রে ততটা হয়নি। এজন্য ঘাটতি দূর হচ্ছে না। সরকারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, আগের তুলনায় ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। তবে চাহিদা বেড়েছে তারচেয়েও বেশি। ঘাটতি পূরণে নানা ধরনের উদ্যোগও নেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। গত কয়েক বছরে নিত্যপণ্যের বাজারে যে জিনিসটির দাম সবেচেয়ে বেশি বেড়েছে তা হলো গরু ও খাসির মাংস। ২০১৫ সালেও প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৩০০ টাকা। সেখানে সরকারের ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) ও কৃষি বিপণন অধিদফতরের ২৩ মার্চের তথ্য অনুযায়ী, বাজারভেদে বর্তমানে প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম ৪৬০-৫০০ টাকা আর খাসির মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকায়। দেশী মুরগির ডিম প্রতি হালি ৪০ থেকে ৪২ ও ফার্মের মুরগির ডিম ৩০ থেকে ৩২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দুর্লভ হয়ে উঠেছে দেশী মুরগি। মাঝারি আকারের একটি দেশী মুরগি ৩৫০-৩৯০ টাকায় ?বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০-১৬৫ টাকায়। তরল দুধের দাম কেজিপ্রতি ৬০-৭০ টাকা। ফলে দেশের দারিদ্র্যতা কমলেও পুষ্টির যোগান দেয়া এ খাদ্যগুলোর দাম এখনও একটি বড় জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দৈনিক ২৫০ মিলিলিটার দুধ ও ১২০ গ্রাম মাংসের চাহিদা রয়েছে। ডিমের চাহিদা বছরে ১০৪টি। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১০ লাখ ধরে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, বছরে দেশে দুধের চাহিদা এক কোটি ৪৬ লাখ ৯১ হাজার টন। সেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৭২ লাখ ৭৫ হাজার টন। সে হিসাবে একজন মানুষের দৈনিক চাহিদার অর্ধেক (১২৫ মিলিলিটার) দুধ উৎপাদন হচ্ছে। দেশে বছরে দুধের উৎপাদনে ঘাটতি ৭৪ লাখ ১৬ হাজার টন। বছরে ডিমের চাহিদা এক হাজার ৬৭৪ কোটি ৪০ লাখ পিস। এরমধ্যে উৎপাদন হয় এক হাজার ১৯১ কোটি ২৪ লাখ পিস। ডিমের ঘাটতি ৪৮৩ কোটি ১৬ লাখ পিস। একজন মানুষ বছরে ১০৪টির পরিবর্তে ৭৫টি ডিম পাচ্ছে। একজন মানুষের দৈনিক মাংসের চাহিদা অনুযায়ী দেশে বছরে ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টন মাংসের প্রয়োজন। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে মাংস উৎপাদিত হয়েছে ৬১ লাখ ৫২ হাজার টন। মাংসের উৎপাদনে ঘাটতি ৯ লাখ টন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচী ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ৩৬ শতাংশ এখনও খর্বকায়, শীর্ণকায় ১৪ শতাংশ শিশু। পাশাপাশি অপুষ্টির কারণে কম ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে ৩৩ শতাংশ শিশু। আইসিডিডিআরবি ও ব্র্যাকের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, উচ্চমাত্রার অপুষ্টির ঝুঁকিতে থাকা বিশ্বের ৩৬টি দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের ৫১ শতাংশ শিশু রক্তস্বল্পতায় (এ্যানিমিয়া) ভুগছে। মায়েদের ক্ষেত্রে এ হার ৪২ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক আইনুল হক বলেছেন, ‘কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। পশুর অধিক উৎপাদনশীল জাত তৈরি হচ্ছে। ৪৫ লিটার দুধ দেয়া গাভীও এখানে তৈরি হয়েছে। ৪০০-৫০০ কেজি মাংস দেয়া গরুও আমরা তৈরির চেষ্টা করছি।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আগামীতে ডেইরি ও মাংসের জন্য বড় একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছি। গাভী পালনের জন্য ৫ শতাংশ হারে ঋণের ব্যবস্থা করেছি।’ আইনুল হক আরও বলেছেন, ‘আমরা উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার জন্য ঋণের ব্যবস্থা করেছি। প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। পশু-পাখির রোগ প্রতিরোধের জন্য টিকাদান কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছি।’ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের ১০ বছরের পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা গেছে, দুধ, ডিম ও মাংসের ঘাটতির কারণ হলো এ সময়ে গবাদিপশু-পাখির সংখ্যা কাক্সিক্ষত হারে বাড়েনি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে মোট গবাদিপশু-পাখির সংখ্যা ছিল ২৯ কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয়েছে ৩৭ কোটি ৪৯ লাখ ৯০ হাজার। এ সময়ে ৮ কোটি ১৫ লাখ গবাদিপশু-পাখি বেড়েছে। এরমধ্যে ২০০৬-০৭ অর্থবছরে গরু, মহিষ, ভেড়া, ছাগলের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৭৫ লাখ ১০ হাজার। গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) তা দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৭ লাখ ৫৭ হাজারে। হাঁস-মুরগির সংখ্যা ২৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে হয়েছে ৩২ কোটি ৬ লাখ ৩৩ হাজার। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, ‘প্রাণিসম্পদ খাতে পশু পালনের মাধ্যমে লাভবান হওয়ার বিষয়টি বেশ দীর্ঘমেয়াদী। সেজন্য পোল্ট্রির সঙ্গে তুলনা করলে এ খাতটি পিছিয়ে আছে। মাংস ও দুধের ঘাটতি মেটানোর জন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘গরুসহ গবাদিপশু পালনের জন্য চারণভূমিসহ জমি লাগে, কিন্তু আমাদের জমির সঙ্কট দেখা দিয়েছে।’ বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব মঞ্জুর মোর্শেদ খান বলেছেন, ‘বেসরকারীভাবে বিনিয়োগের জন্য পোল্ট্রি খাত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যদিও উৎপাদন চাহিদার চেয়ে বেশ কম, তারপরও মানুষ কিনতে পারছে। এখন যা উৎপাদন হচ্ছে, ২০২১ সালে তার দ্বিগুণ দরকার হবে। ওই লক্ষ্যেই পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি কাজ করছে।’ তবে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বেসরকারী বিনিয়োগের গতি খুব কম জানিয়ে এ উদ্যোক্তা বলেছেন, ‘এক্ষেত্রে গোখাদ্যের অভাব এবং গবাদিপশুর রোগ প্রতিরোধের ওষুধের পর্যাপ্ততার ঘাটতি আছে। দামী গরুর নিরাপত্তার জন্য ভাল ওষুধপত্র নেই। এজন্য ওই দিকে বিনিয়োগ করাটা ঝুঁকিপূর্ণ।’ মঞ্জুর মোর্শেদ আরও বলেছেন, ‘উৎপাদনে ঘাটতি থাকায় ক্রেতাদের একটু বেশি দাম দিতে হচ্ছে, এটা ঠিক। তবে দাম না পেলে কেউ বিনিয়োগেও তো উৎসাহিত হবে না।’ জিডিপিতে (মোট দেশজ উৎপাদন) ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদের অবদান ১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যদিও ২০০৯-১০ অর্থবছরে এ হার ছিল ২ দশমিক ০৬ শতাংশ। অপরদিকে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদের প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ২১ শতাংশ। ধীরে ধীরে বাড়ছে দুধের উৎপাদন ॥ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের দেয়া তথ্য থেকে জানা গেছে, দুধের উৎপাদন ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ছিল ২২ লাখ ৮০ হাজার টন। পরের বছর ছিল ২৬ লাখ ৫০ হাজার টন। কিন্তু এর পরের দুই বছরে উৎপাদন আবার কমে যায়। ২০০৮-০৯ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ২২ লাখ ৯০ হাজার ও ২৩ লাখ ৭০ হাজার টন দুধ উৎপাদিত হয়। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত চার বছরে দুধের উৎপাদন যথাক্রমে ৩৪ লাখ ৬০ হাজার টন, ৫০ লাখ ৭০ হাজার টন, ৬০ লাখ ৯২ হাজার টন ও ৬৯ লাখ ৭০ হাজার টন। নয় বছরের মাংস উৎপাদনের চিত্র ॥ ২০০৬-০৭ ও ২০০৭-০৮ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১০ লাখ ৪০ হাজার টন। এর পরের বছর উৎপাদন ৪০ হাজার টন বাড়ে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে দুধের উৎপাদন ১২ লাখ ৬০ হাজার টন। এরপর ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৫ বছরে দুধের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১৯ লাখ ৯০ হাজার টন, ২৩ লাখ ৩০ হাজার টন, ৩৬ লাখ ২০ হাজার টন, ৪৫ লাখ ২১ হাজার ও ৫৮ লাখ ৬০ হাজার টন। ডিমের উৎপাদন ॥ ২০০৬-০৭ অর্থবছরে ডিমের উৎপাদন ছিল ৫৩৬ কোটি ৯৬ লাখ। পরের বছর ডিম উৎপাদিত হয় ৫৬৫ কোটি ৩২ লাখ। কিন্তু ২০০৮-০৯ অর্থবছরে উৎপাদন কমে হয় ৪৬৯ কোটি ৬১ লাখ। ডিমের উৎপাদন ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৫৭৪ কোটি ২৪ লাখ, ২০১০-১১ বছরে ৬০৭ কোটি ৮৫ লাখ, ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭৩০ কোটি ৩৮ লাখ পিস। ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭৬১ কোটি ৭৪ লাখ, ২০১৩-১৪ বছরে এক হাজার ১৬ কোটি ৮০ লাখ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এক হাজার ৯৯ কোটি ৫২ লাখ পিস ডিম উৎপাদিত হয়।
×