ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফিরিয়ে আনতে সহায়তার আশ্বাস ইন্টারপোলের

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় দেশে দেশে অভিন্ন কৌশল গ্রহণের তাগিদ

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৪ মার্চ ২০১৭

জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় দেশে দেশে অভিন্ন কৌশল গ্রহণের তাগিদ

আজাদ সুলায়মান ॥ জঙ্গীবাদ ও আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাস মোকাবেলায় এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের পুলিশ অভিন্ন কৌশল গ্রহণ করে সফল হতে পারে। গোটা বিশ্ব আজ এটা উপলব্ধি করতে পারছে। এ ক্ষেত্রে ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগানো যেতে পারে। ঢাকায় আন্তর্জাতিক পুলিশ সম্মেলনে বাংলাদেশের আইজিপিসহ সবাই এ ধরনের মতামত প্রকাশ করেন। দিনভর আলোচনা ও বৈঠক শেষে দুই দফা ব্রিফিংয়ে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক আবারও জোর দিয়ে বলেছেন, এখানে কোন আইএস নেই। গুলশানের হলি আর্টিজানে যারা হামলা করেছিল তারা দেশী জঙ্গী। তবে তাদের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠীটির ইন্টারনেট যোগাযোগ থাকতে পারে। তিনি বলেছেন, মেজর ডালিমসহ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফিরিয়ে আনার বিষয়েও ইন্টারপোল সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়া রেড নোটিস জারি করা ফেরারিদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ইন্টারপোলের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। ঢাকায় আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের আঞ্চলিক কার্যালয় চালু করার প্রস্তাব রাখার কথাও জানান আইজিপি শহীদুল হক। তিনি বলেছেন, ‘ইন্টারপোলে র‌্যাবের নোটিস তালিকা থেকে যদি কোন অপরাধীর নাম প্রত্যাহার করা হয়, বাংলাদেশ তা ভাল চোখে দেখে না। যেখানে উচ্চ আদালতের রায় রয়েছে, সে রায়ের প্রতি ইন্টারপোলের শ্রদ্ধা দেখানো উচিত। এক সেশনে ইন্টারপোলের মহাসচিব ড. জর্গান স্টোককে ইন্টারপোলে র‌্যাবের পাঠানো নোটিস তালিকা থেকে অপরাধীর নাম প্রত্যাহার করা বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। এর জবাবে জর্গান স্টোক বলেছিলেন, তালিকায় যদি কোন অপরাধীর নাম থাকে, সেক্ষেত্রে সে অপরাধী নির্দোষ বলে রিভিউ করে আমরা সেটি বিবেচনা করে থাকি। উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ইন্টারপোলের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে তারেক রহমান সম্পর্কে প্রাপ্ত সব তথ্য প্রমাণ এবং তার রাজনৈতিক অবস্থান বিশ্লেষণ করে কোন অপরাধের তথ্য না পাওয়ায়, ইন্টারপোল জেনারেল সেক্রেটারিয়েট তাদের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো থেকে তারেক রহমান সম্পর্কে সরকারের দেয়া সব তথ্য মুছে ফেলে। প্রথমবারের মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে একটি সমন্বিত কৌশল প্রণয়ন করার লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় এই পুলিশ সম্মেলন। পুলিশ প্রধানদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে একটি প্লাটফর্ম গঠনও এর লক্ষ্য। সোমবার সকালের বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা ‘রিজিওনাল ইনস্টিটিউশন’ গঠনের প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশসহ ১৫ দেশের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নিয়ে তিনদিনের এই সম্মেলন চলছে সোনারগাঁও হোটেলে। আফগানিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, ভুটান, ব্রুনাই, চীন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনাম এতে অংশ নিচ্ছে। এছাড়া ইন্টারপোল, ফেসবুক, যুক্তরাষ্ট্রের আইজিসিআই, এফবিআই, আসিয়ানপোল ও আইসিআইটিএপিসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তারাও যোগ দিয়েছেন। সম্মেলনের ফাঁকে ব্রুনাই ও ভিয়েতনামের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসেন পুলিশ প্রধান শহীদুল হক। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশীরা কঠোর পরিশ্রম করে বলে সেদেশের প্রতিনিধি আমাদের জানিয়েছেন। ভিয়েতনামের কর্মকর্তারা তাদের দেশে মাদক ও মানবপাচার বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একটি এমওইউ করতে চায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শহীদুল বলেন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ে চীন আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা প্রশিক্ষণ, লজিস্টিক ও ইক্যুইপমেন্ট সাপোর্ট দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়াও ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। ইন্টারনেটেই জঙ্গী হয়েছে ৮০ শতাংশ ॥ ইন্টারনেটে ফেসবুকসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও এ্যাপস ব্যবহার করে দেশী জঙ্গীদের ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ জঙ্গীবাদের পথে ধাবিত হয়েছে। এদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ সাধারণ শিক্ষার্থী, ২২ ভাগ মাদ্রাসার পড়াশোনা ছেড়ে জঙ্গীবাদে জড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ হেড কোয়ার্টার্সের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-গোপনীয়) মোঃ মনিরুজ্জামান। বিকেলের সেশনে তিনি এ তথ্য তুলে ধরেন। সম্মেলনে সোমবারের মূল প্রতিপাদ্য ছিল রিজিওনাল কো অপারেশন ইন কাবিং ভায়োলেন্ট এক্সিট্রিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম। এতে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মনিরুজ্জামান বলেন, জঙ্গীরা আগে শুধু ফেসবুকসহ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যোগাযোগ করত। তবে এখন তারা কৌশল পাল্টে নিরাপদ মেসেজিংয়ের এ্যাপ্লিকেশন (এ্যাপ) থ্রিমাসহ নতুন নতুন এ্যাপস ব্যবহার করছে যে কারণে তাদের শনাক্ত করতে গোয়েন্দাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এজন্য প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ ও প্রশিক্ষণ বাড়াতে হবে। বিকেলে ৮ দেশের আলাদা বৈঠক ॥ বিকেলে বলরুমে এক দিকে যখন ইস্যুভিত্তিক আলোচনা চলছিল তখন দোতলার একটি কক্ষে অংশগ্রহণকারী ৮ দেশের পুলিশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বৈঠক করেন আইজিপি শহীদুল হক। বৈঠকে তাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সাজাপ্রাপ্ত পলাতক খুনীদের ফিরিয়ে দেয়াসহ মাদক ও সন্ত্রাস দমনের কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ প্রধান ইন্টারপোলের মহাসচিব ড. জার্গেন স্টোক মালয়েশিয়া পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল খালিদ বিন আবু বকর, মিয়ানমারের পুলিশের চীফ অব জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিইও সুউ্ই উইন, আফগানিস্তানের সিনিয়র ডেপুটি মিনিস্টার ফর সিকিউরিটি আবদুল রহমান, চীন এনসিবির ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ চেং তাও, কোরিয়ান পুলিশের চীফ সুপারিনটেনডেন্ট জেনারেল কিম কুউই চ্যান, শ্রীলঙ্কা পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল পুজিথ সেনাধি ব্রান্দ্রা এবং ফেসবুকের ট্রাস্ট এ্যান্ড সেফটি ম্যানেজার বিক্রম লেংন্থের সঙ্গে বৈঠক করেন। ইন্টারপোল মহাসচিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন আইজিপি। এসব খুনী হলো লে. কর্নেল নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল আঃ রশিদ, ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। আইজিপি সুনির্দিষ্ট করে ইন্টারপোলকে জানায়, ডালিম স্পেনে আত্মগোপন করে আছে। তার বিষয়ে ইন্টারপোল মহাসচিব আশ্বস্ত করে বলেন, সহায়তা দেয়া হবে। এছাড়া ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পলাতক আসামিদের ফেরত আনার বিষয়েও আলোচনা হয়। আইজিপি সিটিটিসি, সিআইডি, এসবি, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, পিবিআই অফিসারদের বিভিন্ন ট্রেনিং, ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানোর জন্য ইন্টারপোল মহাসচিবকে অনুরোধ জানান। এছাড়া বাংলাদেশ পুলিশকে ই-লার্নিং সংক্রান্ত ট্রেনিং, সেমিনার, কনফারেন্স, ওয়ার্কশপ আয়োজনসহ পুলিশ স্টাফ কলেজকে সম্পৃক্ত করার বিষয়েও আলোচনা হয়। আইজিপি জানান, মালয়েশিয়ার পুলিশ প্রধানের সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশী শ্রমিকদের আইনগত সহায়তা প্রদান, নিরাপত্তা, সন্ত্রাসী কার্যকলাপে নিযুক্ত প্রবাসীদের চিহ্নিতকরণে বাংলাদেশকে সহায়তা করা, যে কোন ধরনের অপরাধ সংগঠনের খবর যথাসময়ে জানানো, এন্টিটেররিজম এবং মানবপাচার সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়। এছাড়া দু’দেশের পুলিশ বাহিনীর মধ্যে ট্রেনিং, সেমিনার ও ওয়ার্কশপ ইত্যাদি বাড়ানোর বিষয়ও আলোচনায় স্থান পায়। তিনি জানান, মিয়ানমারের চীফ অব জেনারেল স্টাফের সঙ্গে আলোচনায় গুরুত্ব পায় মাদক চোরাচালানÑ বিশেষ করে ইয়াবা চোরাচালান সংক্রান্ত বিষয়। দু’দেশের মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যু এবং এর সমাধান নিয়ে আলোচনা হয়। বর্ডার এলাকায় পেট্রোল ডিউটি আরও বাড়নোর বিষয়েও দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। শ্রীলঙ্কার পুলিশ প্রধানের সঙ্গে আলোচনাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া অর্থ ফেরত দেয়ায় তাদের ধন্যবাদ জানানো হয়। চীনের সঙ্গে আলোচনায় গোয়েন্দা তথ্য, সাইবার ক্রাইম, অর্থনৈতিক ক্রাইম, ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন এবং বিশেষায়িত অপরাধ সম্পর্কে পুলিশ অফিসারদের আরও অধিকতর প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার আয়োজন সংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্ব পায়। এছাড়া, উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য লিডারশিপ কোর্সের ব্যবস্থা করা এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কারিগরি সহযোগিতা প্রদানও আলোচনায় স্থান পায়। দক্ষিণ কোরিয়া পুলিশের সঙ্গে আলোচনার শুরুতেই বাংলাদেশের পুলিশ প্রধান চলমান কইকার বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ধন্যবাদ জানান। এছাড়া সাইবার ক্রাইম ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশী পুলিশ অফিসারদের দক্ষিণ কোরিয়ায় আরও অধিকতর প্রশিক্ষণের বিষয়েও আলোচনা হয়। আফগানিস্তানের পুলিশ প্রধান জানান, পাকিস্তানের সঙ্গে দেশটির বেশিরভাগ বর্ডার এলাকা উন্মুক্ত থাকায় তাদের জনগণের গমনাগমনের ওপর নিয়ন্ত্রণ কম। আলোচনাকালে দু’দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক উন্নয়নে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি জানান, ফেসবুক কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনাকালে উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আরও অধিকতর ও নিবিড় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়। যাতে করে সামাজিক যোগাযোগ আরও অধিক বৃদ্ধি পায়।
×