ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

দুই বছরে নেমেছে ১২ ফুট, বোরোর পরিবর্তে কৃষক ঝুঁকছেন রবি আবাদে

বরেন্দ্র অঞ্চলে দ্রুত কমছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৫ মার্চ ২০১৭

বরেন্দ্র অঞ্চলে দ্রুত কমছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নিম্নমুখী হওয়ায় ক্রমাগত সেচ সঙ্কটের মুখে পড়ছে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষি। বিশেষ করে অধিক সেচ লাগে এমন চাষাবাদ কমে যাচ্ছে এ অঞ্চলে। বিশেষত বোরো ধান চাষের ক্ষেত্রে অশনিসঙ্কেত দিয়েছে এ অঞ্চলে। ফলে গত কয়েক বছর ধরে ভূগর্ভস্থ পানির সঙ্কট দেখা দেয়ায় সেচ কম লাগে এমন ফসল আবাদের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। পর্যায়ক্রমে বোরোর চাষাবাদ কমলেও বাড়ছে রবিশস্য যেমন আলু, সরিষা, মসুর, গম, ভুট্টা ও সবজির আবাদ। এ অবস্থায় বরেন্দ্র অঞ্চলের ১৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকাকে পানি সঙ্কটপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৫টি ইউনিয়ন ও তিনটি পৌরসভা রয়েছে। এর মধ্যে অধিক ভূ-গর্ভস্থ পানি সঙ্কটপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইড় ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নকে। ভূ-গর্ভস্থ পানি নিয়ে গবেষকরা এমন তথ্য দিয়েছেন। বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান জানান, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলায় অবস্থিত যেসব ইউনিয়ন ও পৌরসভা পানি সঙ্কটপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেসব এলাকায় গত দুই বছরে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে ৮ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত। তিনি জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বরেন্দ্র অঞ্চলের ১০০টি পয়েন্টে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর সংগ্রহ করা হয়েছে। বোরো মৌসুম শেষে মে মাসে আবারও ১০০টি পয়েন্টে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর সংগ্রহ করা হবে। এরপর চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নের ঝিনাইখোর এলাকায় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পানির স্তর ছিল ৯৯ ফুট নিচে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সেখানে পানির স্তর পাওয়া যায় ১১১ ফুট ৯ ইঞ্চি নিচে। আর চাঁপাইনবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে পানির স্তর ছিল ১০১ ফুট নিচে। যা চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যায় ১০৮ ফুট ৯ ইঞ্চি নিচে। যদিও এক যুগ আগে এসব এলাকায় ৬০ থেকে ৯০ ফুট গভীরে পানির স্তর ছিল। ভূ-গর্ভস্থ পানির গবেষকরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার উঁচুতে অবস্থান করা ঝুঁকিপূর্ণ এসব ইউনিয়ন ও পৌরসভা এলাকাগুলোতে দ্রুত গভীর নলকূপের পানি দিয়ে বোরো আবাদ বন্ধ করার সুপারিশ করে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর জন্য প্রথম পর্যায়ের প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে পানির রিচার্জ করতে বড় পুকুর ও খাল খনন করে ভূ-উপরস্থ পানির ব্যবহার বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। সম্প্রতি বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে গবেষণা সংস্থা ‘ডাসকো ফাউন্ডেশন’ পরিচালিত ‘সমন্বিত পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে গবেষণা শুরু করছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিয়ে প্রতিবছর তারা গবেষণা প্রতিবেদন পাঠায় পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। সংস্থাটির রাজশাহী অঞ্চলের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম খান আরও বলেন, তানোর উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ৭০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। যা গত ২০ বছর ধরে দুই হাজার হেক্টরের বেশি জমিতে সেচ সুবিধা দিয়ে আসছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে থেকে বৌদ্ধপুর মৌজার একটি গভীর নলকূপ পানির অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আর চলতি বছর নাজুক অবস্থায় পড়েছে আরও ২৫টির বেশি গভীর নলকূপ। অপরদিকে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঝিলিম ইউনিয়নে রয়েছে বিএমডিএর ১১৩টি গভীর নলকূপ। এসব গভীর নলকূপের আওতায় প্রায় দুই হাজার ৭০০ হেক্টর কৃষি জমিতে সেচ প্রদান করা হয়ে থাকে। তবে এ ইউনিয়নে ইতোমধ্যেই ১২টি গভীর নলকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। সেগুলোতে আর পানি উঠে না। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সবচেয়ে উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত ঝিলিম ইউনিয়নে অটো রাইসমিল রয়েছে ৩২টি। প্রতিটি অটোরাইসমিলে রয়েছে ৩ থেকে ৪টি করে গভীর নলকূপ। একটি অটো রাইসমিলের গভীর নলকূপের মাধ্যমে যে পরিমাণে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয় তা দিয়ে ৬০০ বিঘা জমির আবাদ করা সম্ভব বলে জানান জাহাঙ্গীর আলম। ঝিলিম ইউনিয়নের জামতলার নওহাটা গ্রামের গভীর নলকূপ অপারেটর কাবা আলী বলেন, তার গভীর নলকূপের আওতায় গত ছয় থেকে সাত বছর আগে যে পরিমাণ পানি উঠত তাতে ১৫০ বিঘার বেশি জমিতে সহজেই সেচ দেয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে যে পানি উঠছে তাতে ৩৫ থেকে ৪০ বিঘার বেশি জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তানোরের বাধাইড় ইউনিয়নের বৌদ্ধপুর গ্রামের গভীর নলকূপ অপরেটর আব্দুল আজিজ জানান, ২০১০ সাল থেকে তার গভীর নলকূপটিতে পানি কমতে থাকে। ২০১৫ সালে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তার এলাকায় এবার ২০০ বিঘার বেশি জমি পতিত পড়ে আছে পানির অভাবে বলে জানান তিনি। এদিকে ভূ-গর্ভস্থ পানি হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজনে যাচ্ছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের চাষীরা। পানির সঙ্কট দেখা দেয়ায় সেচ কম লাগে এ ধরনের ফসল আবাদের দিকে ঝুঁকছেন কৃষকরা। এ অঞ্চলের চাষী ও কৃষিবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলে বাড়ছে পানির সমস্যা। কৃষকরা এখন গভীর নলকূপ থেকেও ঠিকমত পানি পাচ্ছেন না। এই সমস্যা মোকাবেলায় কৃষি বিভাগ কৃষকদের কয়েক বছর থেকে পরামর্শ দিচ্ছেন সেচের পানি কম লাগে এমন ফসল আবাদ করতে। কৃষিবিদরা বলেন, বোরো মৌসুমে ১ কেজি ধান উৎপাদন করতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার লিটার পানি লাগে। অথচ গম, ডাল, মসলা, সবজি জাতীয় ফসলে পানি লাগে অনেক কম। তাই সেচ সঙ্কট মোকাবেলায় কয়েক বছর যাবত বরেন্দ্র অঞ্চলে রবি মৌসুমে বাড়ছে গম, ডাল, মসলা, ভুট্টা ও সবজি জাতীয় ফসলের আবাদ। কৃষকরা বলছেন, রবি মৌসুমে বোরো আবাদ করতে গভীর নলকূপগুলো থেকে ঠিকমত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া অধিক খরচে সেচ দিয়ে আবাদ করে তেমন লাভ থাকে না। সেই জন্য তারা বোরো থেকে সরে আসছেন। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, এখন ক্রমেই বোরোর পরিবর্তে রবিশস্যের চাষাবাদ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে মসুর আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১৯ হাজার ৫শ’ হেক্টর জমিতে তবে আবাদ হয়েছে ২৫ হাজার ৯৯৫ হেক্টরে। বিভিন্ন সবজি আবাদ হয়েছে ১২ হাজার ৮৬৯ হেক্টরে। গমের আবাদ হয়েছে ২৬ হাজার ৮৪১ হেক্টরে, সরিষার আবাদ হয়েছে ১৯ হাজার ৪৯৬ হেক্টরে। অন্যদিকে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৬৩ হাজার ২শ’ হেক্টর ধরা হলেও এবার ৫৫ হাজার ৯শ’ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে। শুধু সেচ সঙ্কটের কারণে গত কয়েক বছর থেকে ক্রমাগত রাজশাহীতে কমছে বোরো আবাদ।
×