ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

এমপি লিটন হত্যা ॥ সোর্স আওয়ামী লীগ নেতা চন্দন কলকাতায়

কাদের খানের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল সুন্দরগঞ্জ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১ মার্চ ২০১৭

কাদের খানের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল সুন্দরগঞ্জ

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা, ২৮ ফেব্রুয়ারি ॥ গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সরকারদলীয় এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যায় কাদের খান সোর্স হিসেবে দীর্ঘদিন আগে থেকেই ব্যবহার করে আসছিলেন এমপি লিটনের কট্টর বিরোধী গ্রুপের অন্যতম উপজেলা আ’লীগের সাবেক সহ-দফতর সম্পাদক চন্দন কুমার সরকারকে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এ কথা স্বীকার করেছেন কাদের খান। এ ব্যাপারে গাইবান্ধার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) রবিউল ইসলাম জানান, এ হত্যাকা-ের সংবাদদাতা এবং কাদের খানের অন্যতম সোর্স হিসেবে চন্দন কুমার সরকারের সম্পৃক্ততার কথা শুধু কাদের খানই নন, চার কিলারই এ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। পুলিশ তাকে খুঁজছে। এদিকে চন্দন সরকার এখন ভারতের কলকাতায় অবস্থান করছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গাইবান্ধার কয়েকজন সাংবাদিককে কলকাতার একটি নম্বর থেকে মোবাইল ফোনে তিনি যোগাযোগ করে বলেন, তিনি এখন কলকাতায় অবস্থান করছেন। তিনি এ ঘটনায় জড়িত নন। তাকে অহেতুক ফাঁসানো হচ্ছে। তবে কাদের খান এবং কিলারদের সঙ্গে তার মোবাইলের কথোপকথন রেকর্ড করা আছে বলে জানানো হলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন। তিনি এ খুনে সম্পৃক্ত না হলে কেন গা-ঢাকা দিলেন- এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, পুলিশ তার খোঁজ করছিল বলেই ঝামেলা এড়াতে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। জানা গেছে, খুনী কাদের খান ও তার অন্য সহযোগীসহ এ খুনের ঘটনায় সম্পৃক্ত যারা এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে ফাঁসির দাবিতে উত্তাল হয়ে উঠেছে সুন্দরগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষ। এজন্য বিভিন্ন ইউনিয়নে এবং উপজেলা হেডকোয়ার্টারে নিয়মিত প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এদিকে পুলিশ কর্তৃক ১৫ দিনের মধ্যেই চাঞ্চল্যকর এ খুনের চার্জশীট দাখিল করার ঘোষণায় জনমনে স্বস্তি বিরাজ করছে। তাদের দাবি, এই সময়ের মধ্যেই সকল খুনীকে অন্তর্ভুক্ত করেই যেন চার্জশীট দাখিল করেন। মঙ্গলবার সরেজমিন সুন্দরগঞ্জ পরিদর্শনকালে বিভিন্ন স্তরের মানুষ এ দাবি জানায়। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এ সার্কেল) রবিউল ইসলাম জানান, ঘোষিত ওই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই চার্জশীট প্রদান করার লক্ষ্য নিয়ে পুলিশ কাজ করে চলেছে। জামায়াত কানেকশন ॥ কাদের খান আবারও এমপি হওয়ার স্বপ্নে এতটাই বিভোর ছিলেন যে, তিনি বিগত জেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের হারিয়ে দিতে জামায়াত এবং বিএনপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোপনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন, যে কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা সুন্দরগঞ্জ থেকে তাদের কাক্সিক্ষত ভোট পেতে ব্যর্থ হন। পক্ষান্তরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী বিপুলসংখ্যক ভোট লাভ করেন। এদিকে জাতীয় পার্টিতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় কাদের খান এমপি লিটনকে হত্যার পর পরবর্তীতে পথের কাঁটা ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকেও হত্যার পরিকল্পনা করেন। এজন্য সুন্দরগঞ্জে জামায়াতের পাশাপাশি নব্য জেএমবিরাও যে জঙ্গী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এটা প্রমাণ করার জন্য পরিকল্পিতভাবে নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেন। তার পরিকল্পনার মধ্যে অন্যতম ছিল বিগত দুর্গা ও কালীপূজায় বিভিন্ন মন্দিরে হামলা চালিয়ে প্রতিমা ভাংচুর করা এবং সেখানে নব্য জেএমবির নামে হাতে লেখা একটি করে চিঠিও ফেলে রাখা হয়। এদিকে কাদের খানের সুন্দরগঞ্জের বাড়িটিও ছিল জনবিচ্ছিন্ন। এখানে সুন্দরগঞ্জের সাধারণ মানুষের যাতায়াত খুব কমই ছিল। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, মোটরসাইকেলে বিভিন্ন লোকজনকে সব সময় সেখানে যাতায়াত করতে তারা দেখেছেন। এদিকে রগচটা কাদের খান তার কথা শুনতে অস্বীকৃতি জানালে বা তার নির্দেশমতো কাজ না করতে চাইলে মুহূর্তেই তিনি তার পিস্তল বের করে ভয় দেখাতে অভ্যস্ত ছিলেন। এমপি থাকাবস্থায় শিক্ষকরা নানা কাজে তার কাছে স্বাক্ষর নিতে গেলে নিয়োগসহ বিভিন্ন কাজে তিনি প্রভাব বিস্তার করতেন এবং তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হতো। এতে দ্বিমত পোষণ করলেই অনেক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পিস্তল দেখিয়ে গুলি করার ভয় দেখান বলেও জানা গেছে। ঘনিষ্ঠদের গা-ঢাকা ॥ কাদের খান নজরবন্দী হওয়ার পর থেকেই তার অতি নিকটের আস্থাভাজনরা গা-ঢাকা দিয়েছে। এমপি লিটনকে হত্যার শলাপরামর্শে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত কাদের খানের ঘনিষ্ঠজনদের আর দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ তাদের ধরতে গোপনে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই কাদের খানের একান্ত ঘনিষ্ঠ ভাগ্নি জামাই ও তার পিএস হাবিবুরের বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন হাই স্কুল ও কলেজের শিক্ষক এ ঘটনার পর থেকে ছুটি ছাড়াই এলাকা থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। চন্দন জিরো থেকে হিরো ॥ সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মনমথ গ্রামের সুশীল চন্দ্র সরকারের ছেলে চন্দন সরকার হঠাৎ করে উপজেলা আ’লীগের সহ-দফতর সম্পাদকের পদ পেয়েই জিরো থেকে হিরো হয়ে ওঠেন। অথচ তার দরিদ্র পিতা কাঠুরে হিসেবে এখনও জীবিকা নির্বাহ করছেন। চন্দন ওই এলাকার কয়েকজন নামধারী সাংবাদিক এবং সন্ত্রাসীকে নিয়ে একটি চাঁদাবাজ গ্রুপ তৈরি করেন। তার নেতৃত্বে এ গ্রুপটির কাজই হলো মূলত নানা অভিযোগ করে টাকা নিয়ে তা মীমাংসা করা। কাদের খান যখন এমপি ছিলেন তখন এমপির বিশেষ বরাদ্দের কয়েকটি প্রকল্পের বিরুদ্ধে তিনি এবং তার অনুসারীদের স্বাক্ষরে বিভিন্ন দফতরে কয়েকটি অভিযোগ দাখিল করেন। এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হলে কাদের খানের লোকজন তার নির্দেশে চন্দনকে ম্যানেজ করে নেয়। এভাবেই কাদের খানের সঙ্গে তার বিশেষ সখ্য গড়ে ওঠে। পরবর্তীতে এমপি লিটন তার এসব চাঁদাবাজি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। এ ক্ষোভে চন্দন সরকার সে সময়কার লিটনবিরোধী আ’লীগের অন্য গ্রুপটির সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং এমপি লিটনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দফতরে নানা অভিযোগ করতে শুরু করেন। পরবর্তীতে লিটনকে একেবারেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে কাদের খানের সঙ্গে সোর্স হিসেবে সম্পৃক্ত হন। চন্দন সরকার এসএসসি পাস করলেও তিনবার পরীক্ষা দিয়েও এইচএসসি পাস করতে পারেননি। ফলে তার লেখাপড়ার ইতি ঘটে এবং উচ্চাকাক্সক্ষার বশবর্তী হয়ে নানাভাবে চাঁদাবাজি শুরু করেন।
×