স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ সেচ সঙ্কটসহ নানা কারণে বোরো আবাদের আওতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলে। তবে ধানের বদলে গম, আলু, ভুট্টা ও সবজিসহ অন্যান্য বিকল্প ফসল চাষের দিকে ঝুঁকছেন এ অঞ্চলের কৃষক।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রমতে, ২০১২ সালে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় ধান চাষ হয়েছিল আট লাখ ৮৪ হাজার ৭৪১ হেক্টর জমিতে। পরের বছর বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় আট লাখ ৫২ হাজার ১২৮ হেক্টর জমিতে। এরপর কোন কোন জেলায় বিচ্ছিন্নভাবে দু-এক মৌসুমে ধান চাষ কিছুটা বাড়লেও সার্বিকভাবে রাজশাহীতে বোরো চাষের পরিমাণ কমছে। এখন আট জেলায় বোরো চাষ হচ্ছে প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরও রাজশাহী অঞ্চলের চার জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার হেক্টর কম জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। সেবার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর মিলে তিন লাখ ৪০ হাজার ৪৪ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়, যেখানে তিন লাখ ৭৪ হাজার ৬৬১ হেক্টর জমিতে চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
জানা যায়, ২০১৪ সালে রাজশাহীতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৯ হাজার ৭১ হেক্টর জমিতে, তবে চাষ হয়েছে ৬৮ হাজার ৮৬ হেক্টরে। নাটোরে ২০১৩ সালে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ হাজার ৪২৫ হেক্টর জমিতে, চাষ হয়েছে ৫৭ হাজার ২২৫ হেক্টরে। পরের বছর ২০১৫ সালে নওগাঁয় বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ দুই হাজার ৩২১ হেক্টরে, চাষ হয়েছে দুই লাখ এক হাজার ৯৯৫ হেক্টরে।
আর গত বছর রাজশাহীতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৯ হাজার ৪১১ হেক্টরে, চাষ হয়েছে ৬৬ হাজার ৪৯০ হেক্টরে। চলতি মৌসুমে রাজশাহীতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬৯ হাজার ৪১২ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত আবাদ হয়েছে মাত্র ২৮ হাজার ২৬ হেক্টরে। জানা যায়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার সবকটি উপজেলা অন্তর্ভুক্ত করে ১৯৯২ সালে গঠিত হয় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। ২০১৫ সালের আগস্টে বিএমডিএর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন ড. আকরাম হোসেন চৌধুরী। বিএমডিএর চেয়ারম্যান পদে যোগ দিয়েই আকরাম হোসেন চৌধুরী বলেছিলেন, ধান চাষ করতে গিয়ে ক্রমেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন করে আর গভীর নলকূপও বসানো হবে না। ফসলে সেচের কাজে পানির অভাব পূরণ করতে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারকে গুরুত্ব দেয়া হবে। প্রয়োজনে ক্যানেল করে নদী থেকে পানি আনা হবে।
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হবে। জানা গেছে, ২০১৩ সালের পর থেকেই এ অঞ্চলে গভীর নলকূপ বসানোর অনুমোদন দিচ্ছে না কৃষি মন্ত্রণালয়। আবার সেচের কাজে ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারের সুযোগও যথেষ্ট পরিমাণে সৃষ্টি করা হয়নি। ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো চাষ কমছেই। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মা-ইল এলাকার কৃষক আলী আকবর বলেন, গত বছর তিনি পাঁচ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। তবে এবার চাষ করবেন সর্বোচ্চ তিন বিঘায়। শ্রমিক খরচের পাশাপাশি ডিজেলসহ সার ও কীটনাশকের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ায় এবং ধানের দাম না পাওয়ায় আগের মতো ধান চাষে আগ্রহ পাচ্ছেন না।
পরিবর্তে গম আর আলু চাষ করছেন। গত বছর প্রায় ১২ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন তানোর উপজেলার রাতৈল গ্রামের কৃষক জাহিদুল ইসলাম। তিনি জানান, এবার নয় বিঘা জমিতে ধান চাষ করবেন। বাকি জমিতে আলু চাষ করছেন। মোহনপুর উপজেলার মোহনপুরের মৌগাছি এলাকার কৃষক হযরত আলী বলেন, এক বিঘা জমিতে ধান চাষে খরচ হয় অন্তত ১৫-১৬ হাজার টাকা। কিন্তু ধান বেচে পাওয়া যায় ১১-১২ হাজার টাকা। ফলে বিঘাপ্রতি ধান চাষ করে লোকসান গুনতে হয় অন্তত তিন-চার হাজার টাকা। এ কারণে ধান চাষে কৃষকরা দিনের পর দিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ধান চাষে টানা লোকসানের কারণে রাজশাহী অঞ্চলে ধানী জমি কেটে পুকুর খননেও ঝুঁকছেন কৃষকরা। বিঘাপ্রতি বছরে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকায় মাছচাষীদের কাছে জমি ইজারা দিচ্ছেন তারা। মাছচাষীরা ওই জমিতে পুকুর কাটছেন। গত তিন-চার বছরে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বিশেষ করে রাজশাহীতে ধানী জমিতে শত শত পুকুর কাটা হয়েছে। ফলে ধান চাষের পরিমাণ কমছে। পুকুর খনন ঠেকাতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা ছাড়াও নানা পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। তবে বন্ধ হচ্ছে না পুকুর খনন।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালী বলেন, ধান চাষ গত কয়েক বছর ধরে কমেছে। তবে তিনি বলেন, ধানের পরিবর্তে কৃষকরা অন্য খাদ্য-ফসল চাষে ঝুঁকছেন। এতে দেশে বিকল্প খাদ্যেরও সুযোগ হচ্ছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: