ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হোসাইন ইমরান

নবীনের পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নবীনের পদচারণায় মুখরিত ক্যাম্পাস

‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি শোনার পর আমাদের ইন্দ্রিয়ানুভূতিতে এক ধরনের বিশ্বব্যাপী চিন্তার দ্বার উন্মোচিত হয়। কারণ, বিশ্বের সকল দেশের সকল মানুষ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনের সুযোগ থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে শুধু জ্ঞানার্জন হয় না, তৈরি হয় নতুন জ্ঞানের। আর এ কারণেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তফাৎ অনেক। কলেজ জীবনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্ত অঙ্গনে পা রাখতে হয় তরুণ শিক্ষার্থীদের। কেননা কলেজ জীবন অনেকটা ধরাবাধা নিয়মের গ-ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এ সময় চাইলে ক্লাস মিস দেয়া যায় না, চাইলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দেয়া যায় না, হঠাৎ করে কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসব সুযোগ-সুবিধা হরহামেশাই ভোগ করা যায়। দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে নতুন বছরের নতুন সেশনের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নবীনদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি ক্যাম্পাস। নবীনদের সমাগমে এখন উৎসবমুখর পরিবেশের পাশাপাশি সিনিয়র-জুনিয়রদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এসব ক্যাম্পাস। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হওয়া তরুণরা পরিবার ও কলেজ জীবনের বাধা ধরা নিয়মের গ-ি পেরিয়ে চোখে একঝাঁক স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বৃহৎ অঙ্গনে আসে। আর এখানেই তাদের সেই স্বপ্নের বাস্তব প্রতিফলন ঘটাতে হয়; গড়তে হয় নিজের চূড়ান্ত ক্যারিয়ার। এদের অনেকে জীবনের লক্ষ্য স্থির করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। আবার অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে জীবনের লক্ষ্য তৈরি করে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এসব নবীনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নতুন দিনগুলোর অনুভূতির কথা। জানা যায়, জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং দেশ ও জাতি নিয়ে তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা। কথা হয়েছিল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ্যান্ড পলিমার সায়েন্স (সিইপি) বিভাগে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী সিফাত আলমের সঙ্গে। শাবি ক্যাম্পাসে ভর্তির সুযোগ পাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, যখন শুনেছি শাবিতে চান্স হয়েছে তখন অনেকটা স্বপ্নের জগতে আছি বলে মনে হয়েছিল। কেননা বড় ভাই এ ক্যাম্পাসে পড়াশোনা করায় শাবি সম্পর্কে আগেই ধারণা ছিল তার। তবে সিইপি বিভাগে নয়, কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা ছিল। মেরিট সিরিয়াল প্রথম দিকে না হওয়ায় সিইপি বিভাগে ভর্তি হতে হয়েছে। এখন তার চিন্তা সিইপিতে ক্যারিয়ার গড়া। ভাল মানের একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া, যাতে দেশের জন্য কিছু করা যায়। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন মাছুম আহমেদ নামের এক শিক্ষার্থী। শাবি ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে পারা নিজের জন্য একটি বড় ধরনের অর্জন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, শুধু পছন্দের ক্যাম্পাস নয়, পছন্দের বিষয় সিএসইতে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এটা সত্যিই অনেক আনন্দের। ভালমানের সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ও নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা এখন তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন জীবন সম্পর্কে এ নবীন শিক্ষার্থীর অভিমত, বিশ্ববিদ্যালয়ে এত স্বাধীনতা থাকা উচিত নয়। কেননা অবাধ স্বাধীনতার ফলে অনেক কিছুই জীবন থেকে হারাতে হয়। বাধা ধরা নিয়মের মধ্যে থাকলে জীবন অনেকটা শৃঙ্খলিত থাকে বলে তার ধারণা। তবে অনেকের আবার, বুয়েট ঢাবি, জাবির মতো অন্যান্য নামী-দামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন থাকে। অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে অনেকেই সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়। তাদের মধ্যে একজন তাওরেম রাহুল সিংহ। তিনি ভর্তি হয়েছেন বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগে। তিনি বলেন, তার পছন্দের ক্যাম্পাস ছিল বুয়েট। আর সেই স্বপ্নকে বুকে লালন করে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছিলাম। ছবি আঁকাআঁকিতে স্কুলে থাকতেই জাতীয় পর্যায়ে প্রথম হয়েছিলাম। তাই পছন্দের বিষয় ছিল আর্কিটেকচার। আর্কিটেক হিসেবে নিজের ক্যারিয়ার গঠন করাই জীবনের লক্ষ্য বলে তিনি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে ভর্তি হয়েছেন মেহেদী হাসান। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি এতটাই খুশি যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় বলে জানালেন। শিক্ষকতার পেশাকে তার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছেন। তিনি বলেন, শুধু একাডেমিক পড়াশোনা করলে চলবে না; বাইরের বিষয় সম্পর্কেও ধারণা রাখতে হবে। রাজনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান ইত্যাদি জ্ঞানের সকল শাখায় একজন মানুষের দক্ষতা থাকা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে এ বছর ভর্তি হয়েছেন সঞ্জিতা মাহাত্ম। তিনি বলেন, তার পছন্দের ক্যাম্পাস ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে ভর্তি হতে না পারায় জাবি ক্যাম্পাসে ভর্তি হওয়া। তবে এখন তিনি জাবি ক্যাম্পাসের মায়ার বেড়াজালে আবদ্ধ বলে জানান। সঞ্জিতা বলেন, জাবি ক্যাম্পাসে সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই মনোমুগ্ধকর। ভর্তি হয়ে বেশ ভালই লাগছে। দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করলেও বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডার হওয়া মূল লক্ষ্য বলে জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তরুণ শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ অংশকেই অধ্যয়ন করা বিষয়কে কেন্দ্র করে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী দেখা যায়। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে নতুন ভর্তি হওয়া মাহমুদুল হাসানের ক্ষেত্রে। তিনি বলেন, উদ্যোক্তা হওয়া তার জীবনের লক্ষ্য। তিনি বলেন, দেশের শিক্ষিতদের মধ্যে একটি বড় অংশ এখনও বেকার। কেউবা চাকরি পাচ্ছেন না। আবার কেউবা পছন্দের চাকরি না পাওয়াতে চাকরি করছেন না। এক্ষেত্রে নিজেই উদ্যোক্তা হলে নিজ কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অন্যান্য শ্রমিকেরও কর্মসংস্থান তৈরি হবে। আর এভাবেই নিজে উদ্যোক্তা হয়ে দেশের বেকার সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি তরুণ উদ্যোক্তাদের মডেল হতে চান মাহমুদুল হাসান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ। তিনি বলেন, মানুষের নৃতত্ত্ব নিয়ে অধ্যয়ন করা হয় নৃবিজ্ঞানে। ভর্তি হওয়ার সময় এ বিষয়ের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত ছিলাম না। মেরিট সিরিয়াল অনুসারেই অনেকটা বাধ্য হয়ে তাকে এ বিভাগে ভর্তি হতে হয়েছে। তবে এখন বেশ ভাল লাগছে বলে জানান মাহমুদ। ভালভাবে এ বিষয় অধ্যয়নের মাধ্যমে নৃবিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখার দ্বার উন্মোচন করা তার জীবনের লক্ষ্য বলে জানান। একসময় উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেয়েদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। তবে এখন মেয়েরা আর পিছিয়ে নেই। আজকের মেয়েরা নিজেদের মেধার বিকাশের মাধ্যমে সক্ষম হয়েছে নিজের অবস্থান তৈরি করতে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ছেলে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় সমানের কাছাকাছি। সমাজের সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে কেবল নিজেদের মেধার বলেই তা সম্ভব হয়েছে। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে এ বছর ভর্তি হয়েছেন প্রজ্ঞা প্রমিতা। তিনি বলেন, তার জীবনের স্বপ্ন ছিল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে তার সে স্বপ্নপূরণ হয়েছে। প্রমিতা বলেন, নিজেকে কখনও মেয়ে বলে দুর্বল ভাবিনি। আর সেই বিশ্বাস থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু। প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে নিজেকে আসীন করে দেশ ও জাতির উন্নয়নে কাজ করার প্রবল ইচ্ছা বলে জানান প্রমিতা। প্রতি বছরই তরুণ শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি বাতিল করে পছন্দের বিষয়ে পড়ার জন্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে একজন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে ভর্তি হওয়া জাহিদ হাসান। তিনি আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক হিস্ট্রি এ্যান্ড কালচার বিভাগে ভর্তি ছিলেন। শাবিতে পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুয়োগ পাওয়ায় এখানে তার ভর্তি হওয়া। জাহিদ বলেন, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে পড়ব বলে আগে থেকেই মনস্থির করেছিলাম। তাই শাবিতে সুযোগ পাওয়ায় ভর্তি হওয়া। শাবিতে ২০১৬-১৭ সেশন থেকে নতুনভাবে যাত্রা করেছে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগ। এ বিভাগে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন ইমরান বলেন, বাংলাদেশে সমুদ্র বিজ্ঞান বিভাগটি নতুন। অথচ এই বিষয়টি অপার সম্ভাবনাময়। আমাদের সমুদ্র অঞ্চলকে দেশের উন্নয়নে ব্যবহার উপযোগী করে তুলতে প্রচুর জনবল প্রয়োজন। সে অনুসারে বাংলাদেশে পর্যাপ্ত জনশক্তি নেই। সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত সম্পদের উদঘাটনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নকে আরও ত্বরান্বিত করতে চান সাজ্জাদ। তার মতে সকলেরই দেশের জন্য কিছু করা উচিত। কেননা এই দেশ আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে। তাই আমাদের ও দেশকে ভালবেসে কিছু দেয়া উচিত। পরিবার ও কলেজ জীবনের বাধাধরা নিয়মের গ-ি পেরিয়ে অনেকটা মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে নবীন শিক্ষার্থীরা। এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখে একঝাঁক স্বপ্ন। তবে ক্যাম্পাসে প্রবেশের পর এসব নবীনদের শঙ্কারও শেষ থাকে না। র‌্যাগিংয়ের পাশাপাশি নতুন জায়গায় নিজেকে মানিয়ে নেয়ার আশঙ্কায় অনেকটা ভয়ে থাকে এসব নবীন শিক্ষার্থীরা। তবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যে একসঙ্গে চলার মাধ্যমে এসব নবীনদের সম্পর্ক সহপাঠী থেকে উত্তরোত্তর বন্ধুত্বের দিকে ধাবিত হয়। র‌্যাগিং সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ইশাদ মাহমুদ বলেন, আমরা প্রথমবারের মতো পরিবার ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করি। এ সময়টাতে আমরা এমনিতেই একাকিত্ববোধ করি। এমন সময়টাতে র‌্যাগিং করা উচিত নয়। একটি দেশে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনেক সমস্যা থাকে। তবে এর পাশাপাশি অনেক সম্ভাবনাও থাকে। বাংলাদেশ অপার সম্ভাবনাময় একটি দেশ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া এসব তরুণ শিক্ষার্থীরাই একদিন এ দেশের কর্ণধার হয়ে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে থাকবে সকল বাধা-বিপত্তির। তাই তরুণদের উদ্দেশ্যে তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতার একটি অংশ উত্থিত করতে হয়- ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বৈশাখীর ঝড় তোরা সব জয়ধ্বনি র্ক! তোরা সব জয়ধ্বনি র্ক!!
×