ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪৩১

আখের গোছানো ও আধিপত্য বিস্তারই আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলের মূল কারণ

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আখের গোছানো ও আধিপত্য বিস্তারই আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলের মূল কারণ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ অন্তঃকলহের আগুনে পুড়ছে আওয়ামী লীগ। হঠাৎ করেই তা যেন বেপরোয়া আকার ধারণ করেছে। ক্ষমতায় থাকা দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভেদ সর্বত্রই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, বরং দেশের অনেকস্থানেই আওয়ামী লীগের মুখোমুখি এখন আওয়ামী লীগই। দলটির মধ্যে কোন্দল-দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে দু’জনের প্রাণহানির ঘটনা ও সম্প্রতি কিছু নেতাকর্মীর প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকা-ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে সরকারে থাকা দলটি। সরকারের মেয়াদ যতই শেষের দিকে যাচ্ছে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঐক্যের বদলে কোন্দল ততই প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে প্রায়শই নিজেদের মধ্যে প্রাণঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে আওয়ামী লীগসহ তাদের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলো। কেন্দ্রীয় হাইকমান্ড থেকে বারংবার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হলেও তৃণমূলে চেন-অব-কমান্ড কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না দলটি। সর্বশেষ সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে দলের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক সাংবাদিক নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির মধ্যে তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছে। মাত্র এক সপ্তাহের ঘটনায় সিরাজগঞ্জ ও কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দু’জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দলটির চেন অব কমান্ড নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পাওয়া না-পাওয়া থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধ, অন্তর্কলহ থাকবে- এটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে এটা আওয়ামী লীগের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত। কারণ তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের বিপরীতে দলগত শক্ত কোন প্রতিপক্ষ নেই। ফলে সাংগঠনিক কর্মকা-ের বদলে দলটির নেতাকর্মীরা ব্যক্তিগত নানা সুযোগসুবিধা আদায়ের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, খুনোখুনি। কর্মী থেকে নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি, কর্মীদের বদলে এমপি-মন্ত্রী-নেতাদের নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলা ইত্যাদি নানা কারণেই বিভিন্নস্থানে দলটির বিবদমান নেতারা ভ্রাতৃঘাতী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের তিনবছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এটি যেন আমাদের নীতিনির্ধারকরা ভুলে গেছেন। দলের যে লোকগুলো গত আট বছরে সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, এখনও তারা সে জায়গাতেই আছেন। দুই মেয়াদেই বঞ্চিতরা বঞ্চিতই হয়েছেন। আদর্শিক নেতারা নিষ্ক্রিয় হওয়ার সুযোগে সুযোগসন্ধানী ও অনুপ্রবেশকারীরা সর্বত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এসব কারণেই দেশের বেশিরভাগ স্থানে কোন্দল-দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব অর্জন, সফলতা ধ্বংস করে দিতে দলেরই কিছু নেতা-কর্মী যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এখন দেশজুড়ে শক্তহাতে শুদ্ধি অভিযান না চালালে আগামী নির্বাচনে দলকে বড় ধরনের মাশুল গুনতে হতে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করেন তারা। তবে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœকারী কাউকেই যে আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে না, একথাটি স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, অন্যায় করে কেউ পার পাবে না, সে আওয়ামী লীগের যত বড় নেতাই হোক। সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে সাংবাদিক আবদুল হাকিম শিমুল নিহত হওয়ার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও দলীয় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দোষী প্রমাণিত হলে যেই-ই হোক তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জে এক সাংবাদিক নিহত হওয়া ছাড়াও মাত্র দু’সপ্তাহের ব্যবধানে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নিজেদের মধ্যে দেশের বিভিন্নস্থানে ভয়াবহ সংঘর্ষ, কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে ইদ্রিস আলী এবং নড়াইলে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রভাষ রায় নিহত এবং সর্বশেষ চাঁদপুরের হাইমচরে একটি বিদ্যালয়ে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীদের দিয়ে বানানো মানবসেতু দিয়ে সেই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেনের হাঁটার সচিত্র সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। এসব ঘটনায় ক্ষমতায় থাকা দল আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকেও বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, সারাদেশে দলের মধ্যে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব, বিবাদ নতুন কিছু নয়। প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের মুখোমুখি ছিল আওয়ামী লীগই। বেশিরভাগ স্থানেই বিদ্রোহী প্রার্থিতা ঠেকাতে পারেনি দলটি। মুখে কঠোর ভাষা ব্যবহার করা হলেও কার্যত দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকারী বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তৃণমূলের সর্বত্রই অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভেদ পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। নেতাদের অভিযোগ, এটা শুধু আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাদের দ্বন্দ্ব বা অসন্তোষের ফল নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দলের মধ্যে বিদ্রোহের পেছনে দলের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা ও সংসদ সদস্যদেরও হাত রয়েছে। অনেকস্থানেই খোদ দলের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশও অমান্য করে দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন অনেক মন্ত্রী-এমপি-নেতারা। এসব কারণে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল তৃণমূলের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে তৃণমূলের অনেক নেতাই অভিযোগ করেছেন, প্রথম থেকেই শক্তহাতে এসব নিয়ন্ত্রণ করা হলে এভাবে আওয়ামী লীগকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হতো না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, সাংবাদিক হত্যায় দায়ী ব্যক্তিদের কিছুতেই ছাড় দেয়া হবে না। সে যেই হোক তাকে বিচারের আওতায় আনা হবে। তবে এ ঘটনা কোন অনুপ্রবেশকারীর মাধ্যমে হয়েছে কিনা তাও তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, এখন আওয়ামী লীগে অনেকেই অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। কোন ষড়যন্ত্রকারী যাতে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য সবার সতর্ক থাকতে হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগামী নির্বাচন হতে আর দু’বছরও বাকি নেই। ক্ষমতার মেয়াদ যতই দ্রুত ঘনিয়ে আসছে, ‘পাওয়া না-পাওয়া’ হিসেবে অঙ্ক কষতে গিয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে দলটিতে। দীর্ঘদিন থেকে মন্ত্রী-এমপি ও জেলার বড় বড় নেতাদের নিজস্ব বাহিনী তৈরি, আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখল বাণিজ্য, দলীয় নেতাকর্মীদের উপেক্ষা এবং সর্বোপরি তৃণমূল সম্মেলনে নিজেদের পছন্দের অযোগ্য ব্যক্তিদের বসানোর কারণেই এমন হানাহানি, কোন্দল, দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তৃণমূলে চলা অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিরসনে কেন্দ্র থেকে কোন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় তা এখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ এসব সংঘাতের বিষয়ে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মত হচ্ছে, এসব সংঘাতের পেছনে রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কারণ খুবই কম। এলাকায় প্রভাব বিস্তার, জলমহাল, বালুমহাল, ঠিকাদারি, ব্যবসা-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই বেশিরভাগ সংঘর্ষ বা বিরোধী তৈরি হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও কিছু কিছু জায়গায় বিরোধ তৈরি হয়েছে, যার জের এখনও রয়ে গেছে। এখনই কোন্দলপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে দ্রুত শুদ্ধি অভিযান না চালালে আগামীতে এসব ঘটনা আরও মারাত্মক রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের।
×