ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১

বুড়িগঙ্গার দূষণ বেড়েই চলেছে, পরিস্থিতি উন্নতির কোন লক্ষণ নেই

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭

বুড়িগঙ্গার দূষণ বেড়েই চলেছে, পরিস্থিতি উন্নতির কোন লক্ষণ নেই

তপন বিশ্বাস ॥ বুুড়িগঙ্গার দূষণ পরিস্থিতির কোন উন্নতি নেই। দিন দিন পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দূষণ রোধে সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কার্যকরী কোন পদক্ষেপ দৃশ্যমান হয়নি। এ কারণে নদীর পানির রং আরও কালো আকার ধারণ করছে। তারা বলেন, আগামী মার্চ-এপ্রিল নাগাদ বুড়িগঙ্গার পানি বর্জ্যরে আকার ধারণ করবে। দূষণ রোধে সমন্বিত পদক্ষেপ না নেয়া হলে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না। তাদের মতে, হাজারীবাগ এলাকা থেকে ট্যানারি শিল্প সরানোর পাশাপাশি কোন পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য যাতে নদীতে না পড়ে সেদিকে কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে। বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি দায়ী প্রতিষ্ঠান ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে এখনও গড়িমসি করা এ ট্যানারি শিল্প যতদিন না সরছে ততদিন বুড়িগঙ্গা দূষণ মুক্তির আশা করা যায় না। সরেজমিন বুড়িগঙ্গার পাশ ঘুরে দেখা গেছে, বর্ষা কমে যাওয়ায় নদীর পানি আরও কুচকুচ আকার ধারণ করছে। নদীর কিনারে গেলে দুর্গন্ধ আগের মতো নাকে এসে লাগছে। শুধু তাই নয়, নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে স্থাপিত ড্রেনের মাধ্যমে দূষিত তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে পড়তে দেখা গেছে। নিয়মিতই নদীতে ফেলা হচ্ছে গৃহস্থালি বর্জ্যসহ কঠিন বর্জ্যগুলো। বুড়িগঙ্গা পাড়ে একাধিক স্থান রয়েছে যেখানে এখানও রাশি রাশি ময়লা-আবর্জনা ফেলা হয়। আবর্জনা থেকে জীবিকা অনুসন্ধানকারী শিশুরা এসব আবর্জনার স্তূপে ভিড় করছে। কামরাঙ্গীরচর এলাকার একাধিক স্থানে এসব আবর্জনা ফেলার স্তূপ গড়ে উঠেছে। কঠিন বর্জ্যরে পাশিপাশি প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গার দু’পাড়। দেখার যেন কেউ নেই। বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানান, বুড়িগঙ্গায় প্রতিনিয়ত নানা ধরনের বর্জ্য এসেছে পড়ছে। অথচ এটি রোধ করা কোন একক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নয়। যেমন কঠিন বর্জ্য নদীতে ফেলা রোধে রয়েছে সিটি কর্পোরেশন। আবার পয়ঃবর্জ্য যেগুলো পড়ছে তা রোধ করার একমাত্র দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো ঢাকা ওয়াসা। আবার শিল্প বর্জ্য রোধে পরিবেশ অধিদফতর ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে। এছাড়া নদীর ভেতরে চলাচলকারী জাহাজগুলো থেকে যেসব বর্জ্য নদীতে পড়ছে তা দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের। অথচ বুগিড়ঙ্গার দূষণ রোধে এসব প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে দেখা যায়নি কখনও। এখন পর্যন্ত কার্যকরী ও সমন্বিত কোন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তবে একাধিক প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত বুড়িগঙ্গা দূষণ করে গেলেও এককভাবে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে। আর এ ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের দাবি দীর্ঘদিনের। সরকার সাভারে ট্যানারি মালিকদের জন্য আলাদা জায়গা বরাদ্দ দিলেও এখন পর্যন্ত ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরের কোন অগ্রগতি নেই। মালিক ও সরকারপক্ষের দ্বন্দ্বের কারণে একাধিকবার সময় দিয়েও স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি ট্যানারি শিল্প। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যানারি শিল্প সরানো গেলে বুড়িগঙ্গা প্রায় অর্ধেক দূষণমুক্ত হবে। তবে তারা বলছেন, শুধু ট্যানারি শিল্পই নয়, নদী দূষণের সঙ্গে আর যেসব প্রতিষ্ঠান জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে বুড়িগঙ্গা বাঁচানো যাবে না। আর বুড়িগঙ্গা না বাঁচলে ঢাকার পরিবেশের ওপর চরম বিপর্যয় নেমে আসবে। তারা বলেন, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদীগুলো আজ মারাত্মক বিপর্যয়ের শিকার। মানুষের জীবন ক্ষতি করে কোন উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে সে উন্নয়ন কোন কাজে আসবে না। ট্যানারি শিল্পের কারণে যে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে তার দায়-দায়িত্ব এসব শিল্প মালিকদের নিতে হবে। কারণ ব্যবসার মাধ্যমে তারা মুনাফা অর্জন করছে। অথচ দূষণের ক্ষতির শিকার সাধারণ মানুষ হতে পারে না। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য দায়ী হলেও কখনও এর বিরুদ্ধে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া না হলে বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধ করা যাবে না। দূষণ রোধ করা না গেলে নদী বাঁচানো যাবে না। নদী না বাঁচলে ঢাকা বসবাসের জন্য অনুপোযুক্ত হয়ে পড়বে। এখন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে বুড়িগঙ্গা দূষণ রোধে তারা কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বুড়িগঙ্গা দূষণের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসাও ব্যাপকভাবে জড়িত। রাজধানী ঢাকার সব পয়ঃবর্জ্যরে শেষ ঠিকানা হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। অথচ পয়ঃবর্জ্য রোধে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। ওয়াসার এমডি তাসকিন আহমেদ খান এক অনুষ্ঠানে বুড়িগঙ্গা দূষণে ওয়াসার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে বলেন, নদী দূষণের জন্য ওয়াসা মাত্র ১৫ ভাগ দায়ী। বিশেষ করে স্যুয়ারেজের লাইনের মাধমে পয়ঃবর্জ্য নদীতে পড়ছে। তিনি বলেন, পয়ঃবর্জ্যরে দূষণ রোধে ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মাস্টারপ্ল্যান হাতে নেয়া হয়েছে। এটি বাস্তায়বায়ন হলে ২০২৫ সাল নাগাদ কোন পয়ঃবর্জ্য ট্রিটমেন্ট ছাড়া নদীতে পড়বে না। তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা দূষণের কারণে ওয়াসা এ পানি ট্রিটমেন্ট করতে পারছে না। শীতলক্ষ্যার পানি ডাবল ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর বিকল্প হিসেবে ওয়াসা মেঘনা ঘাট ও পদ্মা নদী থেকে পানি আনার জন্য মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে ৭০ ভাগ পানি সরবরাহ করা যাবে। তখন ভূগর্ভস্ত পানির চাপ অনেক কমে আসবে। এছাড়া নদীতে যেসব জাহাজ ভিড়ছে ও সদরঘাট থেকে যেসব জাহাজ বিভিন্ন বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে যাচ্ছে এসব জাহাজ থেকে প্রতিদিন টন টন পোড়া মবিলসহ জ্বালানি তেল নদীতে পড়ছে। ফলে এর মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা দূষণে বিশাল ভূমিকা রয়েছে। তবে বিআইডব্লিটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, জাহাজের মাধ্যমে যেসব তরল বর্জ্য নদীতে পড়ছে এটা রোধ করার দায়-দায়িত্ব তাদের নয়। এটা দেখার দায়িত্ব ডিজি শিপিংয়ের হলেও এ বিষয়ে তাদের কোন কর্যকর পদক্ষে দেখা যাচ্ছে না। তবে তারা বলেন, বুড়িগঙ্গাসহ চার নদী রক্ষায় প্রতিষ্ঠান থেকে নদীর পাড়ে বনায়নসহ ২০ কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। ৪ হাজার ৬৩ নদীর সীমানা পিলার নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া নদী দূষণ রক্ষায় প্রতিষ্ঠানটি কাজ করছে। তবে নদীতে সরকারের বিআইডব্লিটিএর পক্ষ থেকে সীমানা পিলার বসানো হলেও বেশিরভাগ পিলার সঠিক স্থানে বসানো হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিলার বসানোর ভুলের কারণে নদী দখলে উৎসাহিত করা হয়েছে। এ কারণে দূষণ বাড়ছে বলে তারা উল্লেখ করেন। পরিবেশ সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ আব্দুল মতিন বলেন, বিআইডব্লিটিএ যে পিলার স্থাপন করেছে তার বেশিরভাগই ভুল জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে। এর কারণে নদী দখল প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হয়েছে। সরেজমিন সদরঘাটের দু’পাশ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এ এলাকায় যে পরিমাণ দখল ছিল তা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে উচ্ছেদকৃত এলাকায় সীমানা প্রাচীর দেয় হয়েছে। এছাড়াও কিছু কিছু এলাকায় গাছ লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি আবার অনেক এলাকাও নতুন করে দখল হয়ে গেছে। বিশেষ করে কামরাঙ্গীরচর এলাকার লোহারপুর থেকে শুরু করে আদি বুড়িগঙ্গা যে পথ দিয়ে বয়ে গেছে তার সবই বর্তমানে দখলে চলে গেছে। ওই এলাকায় দখল পরিস্থিতির এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, চেষ্টা করলেও তা পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে বাবুবাজার পর্যন্ত নদীর ভেতরে পানির অস্তিত্ব কম থাকলেও এসব এলাকা আবর্জনার স্তূপে পরিণত হচ্ছে। রাশি রাশি ময়লা-আবর্জনা ঠিকই জানিয়ে দিচ্ছে এটি একটি আবর্জনার ভাগাড়। এলাকাবাসীও প্রতিনিয়ত এসব জায়গায় ময়লা ফেলছেন।
×