ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৫ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১

শীর্ষ ছোঁয়ার অপেক্ষায় এক সফল নারী

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৭ জানুয়ারি ২০১৭

শীর্ষ ছোঁয়ার অপেক্ষায় এক সফল নারী

ইচ্ছা ছিল বিজ্ঞানী হওয়ার, আর বাবা-মা স্বপ্ন দেখতেন মেয়েকে বানাবেন ডাক্তার কিন্তু হয়ে গেলেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা। হোসনে আরা বেগম এনডিসি বর্তমানে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি অতিরিক্ত সচিব থেকে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদে পদোন্নতিও পেয়েছেন। তার নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এখন গ্রেড-১ প্রতিষ্ঠান। মাত্র কয়েক বছর আগে দায়িত্ব নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের কারিগর প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। ছাত্রজীবন থেকেই ইচ্ছা ছিল উদ্ভিদ বিজ্ঞানে ভাল কিছু করবেন। তখন টিস্যু কালচার নিয়ে গবেষণাও করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স অব সায়েন্স ডিগ্রী অর্জন করেন। জার্মানিতে একটি যৌথ গবেষণাপত্র প্রকাশও হয়েছিল এই টিস্যু কালচারের ওপর। স্বপ্ন দেখেছিলেন এই বিষয়ে দেশে আলোড়ন ফেলে দেবেন, কিন্তু তা আর হলো না। কর্মজীবনে নিতান্তই সাধারণ এই সরকারী কর্মকর্তা ১৯৮৩ সালের ৩ এপ্রিল ফরিদপুর সদরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ৭৫০ টাকা বেতনে প্রথম কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো যে ৪০ জন নারী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ পান, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন হোসনে আরা। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের প্রথম দিকে ১৯৮৭ সালে টাঙ্গাইল সদরে, ৮৯ সালে জামালপুর সদরে এবং ৯১ সালে মুন্সীগঞ্জ সদরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে মাঠ পর্যায়ের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৯২ সালের জুন মাসে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে ফিরে আসেন ঢাকায়। চার মাস পর বদলি হন কৃষি মন্ত্রণালয়ে। একই পদে ৯৬ সালের জুন পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে চলে যান নেদারল্যান্ডস। সেখান থেকে ফিরে ১৯৯৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ময়মনসিংহের ত্রিশালে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন প্রকল্প, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পদোন্নতি পেয়ে ২০০৯ সালের ৩ আগস্ট থেকে ২০১০ সালের ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের এবং ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর থেকে ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যুগ্ম-সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ২০১০ সালে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ থেকে এনডিসি ডিগ্রী ঠিকই অর্জন করেন তিনি। হোসনে আরা বেগম ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে তিনি বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত ১১ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে অতিরিক্ত সচিব থেকে ভারপ্রাপ্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। প্রথম থেকেই দেশজুড়ে হাইটেক পার্ক তৈরির দায়িত্ব ছিল, এই পদোন্নতি পাওয়ার পর সেইসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেছে বলে মনে করেন তিনি। হোসনে আরা বেগম দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর কারওয়ান বাজারস্থ জনতা টাওয়ারে দেশের প্রথম সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোধন করা হয়। ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট তারিখ গাজীপুরের কালিয়াকৈর হাইটেক পার্কের ৩ নং ব্লকের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ টেকনোসিটি লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ। ফাইবার এ্যাট হোম কনসোর্টিয়াম বাংলাদেশ টেকনোসিটি লিমিটেড একই বছরের ১৫ নবেম্বর পার্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১নং ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করে। সামিট টেকনোপলিস ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পার্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২ এবং ৫ নম্বর ব্লকের ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে হোসনে আরা বেগম বলেন, দুই মাসের মধ্যে আমাদের যশোরে সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। সেই লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই ৭টি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছি। এছাড়াও সম্প্রতি এডিবির সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী এডিবির দেয়া ২৫০ মিলিয়ন ডলারে আমরা যশোরে একটি ২০ তলা মাল্টি ট্যানেন্ট বিল্ডিং এবং পূর্বাচলে আইসিটি অধিদফতরের এক একর জায়গায় ২০ তলা ভবন তৈরি করব। তবে পূর্বাচলের এই ২০ তলা ভবনের জমি দেয়ার শর্তে পাঁচতলা পাবে আইসিটি অধিদফতর। এছাড়াও ইতোমধ্যেই নাটোরে ইনকিউবেটর কাম ট্রেনিং সেন্টার তৈরি হচ্ছে। আগামী ২ বছরের মধ্যে এটি চালু হবে। এছাড়াও সারাদেশে ১২টি আইটি পার্ক তৈরির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরজন্য ইতোমধ্যেই ভারতে ক্রেডিট লাইনের সঙ্গে আমাদের একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে। তারা আমাদের ১৯৩ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিবে। পাশাপাশি জিওবি ফান্ড থেকে আরও ৭টি ইনকিউবেটর কাম ট্রেনিং সেন্টার তৈরি হবে। এগুলো একনেকের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। চলতি বছরের মার্চেই তার চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি চাই আগামী চার বছরের মধ্যে সারাদেশের হাইটেক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, টেনিং সেন্টারে আমরা যাদের বেড়ে ওঠার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছি, তাদের দেয়া ভাড়া দিয়েই হাইটেক পার্ক অথরিটির কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা দেয়া সম্ভব হবে। আমি হাইটেক পার্ক নিয়ে আমার সবধরনের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করে যেতে চাই। সেটা বর্তমান দায়িত্বে বহাল থেকে হোক বা সরকারের সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসেবে, যেভাবে সরকার চান।’ হোসনে আরা বেগম ১৯৫৮ সালের ২৬ মার্চ পটুয়াখালি জেলার কলাপাড়ায় নানা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। দাদাবাড়ি পিরোজপুর জেলার ভা-ারিয়া উপজেলার দক্ষিণ বোথলা গ্রামে। তার বাবা মরহুম মোহাম্মদ আবদুল জব্বার ছিলেন সুগার মিলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। মা মাহমুদা বেগম গৃহিণী। আবদুল জব্বার ও মাহামুদা বেগমের সাত সন্তানের মধ্যে হোসনে আরা বেগম দ্বিতীয়। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে হোসনে আরা বেগমের সুখের সংসার। স্বামী জাহিদুল ইসলাম রিয়েল এস্টেট ও শেয়ার ব্যবসা করেন। বড় মেয়ে হোমায়রা ইসলাম ইউল্যাব থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে মার্স সল্যুশন নামের একটি আইটি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ছেলে তানভীর তাবাসসুম জার্মানির রাভেঞ্জবুর্গে ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ইতোমধ্যেই তিনি এ্যাডুকেশন গসিপ নামের একটি ডিজিটাল স্কুল প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেছেন।
×