ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ফাঁসির অপেক্ষায় বছরের পর বছর ১৩শ’ আসামি কনডেম সেলে

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭

ফাঁসির অপেক্ষায় বছরের পর বছর ১৩শ’ আসামি কনডেম সেলে

শংকর কুমার দে ॥ দেশের ৬৮টি কারাগারের কনডেম সেলগুলোতে ফাঁসির অপেক্ষায় প্রহর গুনছে ১৩শ’ মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। ফাঁসির আসামির সংখ্যায় আরও যুক্ত হয়েছে নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ২৬ ফাঁসির আসামি। ফাঁসির আসামিদের অনেকেই ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছে কনডেম সেলে। বর্তমানে ৪ শতাধিক ডেথ রেফারেন্স মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে হাইকোর্টে। মামলার পেপারবুক তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা, পর্যাপ্তসংখ্যক বেঞ্চের অভাব, বিলম্বে শুনানি হওয়া, সরকার ও আসামি পক্ষের আইনজীবীদের উদাসীনতাসহ নানা কারণে বছরের পর বছর ধরে ফাঁসির আসামিরা মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে রয়েছে কারাগারের কনডেম সেলের অন্ধপ্রকোষ্ঠে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা অধিদফতর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ফাঁসির আসামিদের যেই কনডেম সেলে রাখা হয় তাকে এক কথায় বলা হয় কারাগারের ভেতর আরেক কারাগার। কনডেম সেলগুলো অপেক্ষাকৃত নির্জন এবং সুরক্ষিত দরজা একটাই কিন্তু কোন জানালা নেই। অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। সেখানেই তাদের দিন কাটে। সকাল দুপুর সন্ধ্যা তিন বেলা খাবার দেয়ার সময় দরজা খুলে তাদের খাবার দেয়া হয়। দেশের ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং ৫৫টি জেলা কারাগারেই রয়েছে ফাঁসির আসামি। উচ্চ আদালতে এদের রায় বহাল থাকলে আইন ও কারাবিধি অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত ৪৪ বছরে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে ৪৪০ জন আসামির। কারাগার সূত্রে জানা গেছে, গত অক্টোবর মাসে সর্বশেষ দুই বিচারক হত্যা মামলায় খুলনা কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গী সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) নেতা আসামি আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের। ২০০৫ সালের ১৪ নবেম্বর সকালে ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতে যাওয়ার পথে দুই বিচারককে বহনকারী মাইক্রোবাসে বোমা হামলা করে জ্যেষ্ঠ বিচারক জগন্নাথ পাঁড়ে ও সোহেল আহমেদকে হত্যা করে জঙ্গীরা। এর আগে দুই বিচারক হত্যা মামলার ফাঁসির রায়ে জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমানের ভাই আতাউর রহমান সানি, জামাতা আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল্লাহ ওরফে ফারুকের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। এর আগে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় যুদ্ধাপরাধে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত ছয় যুদ্ধাপরাধীর। এর আগে গত মে মাসে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে দেশের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে। তাকে নিয়ে ছয় যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। অপর যে ছয় যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয় তারা হচ্ছেন, বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের সাকা চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, জামায়াতেরই অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যেসব আলোচিত ব্যক্তি মৃত্যুদ-ে দ-িত হওয়ার পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছেÑ ডাঃ ইকবাল হোসেন, সাংবাদিক নিজামউদ্দিনের কন্যা শারমিন রীমা হত্যার আসামি মনির হোসেন (খুকু মনি), কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার, জঙ্গী নেতা বাংলাভাই, আতাউর রহমান সানী, ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পাঁচ আসামি লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ও মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদা। রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার, দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ প্রমুখ। কারা অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে যে ১৩শ’ ফাঁসির আসামি রয়েছেন তাদের সকলের ফাঁসি কার্যকর হবে না। কারণ উচ্চ আদালতে অনেকেই আপীল করেছেন। উচ্চ আদালত থেকে কেউ কেউ খালাস পেয়ে যান। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিম্ন আদালতের রায়ই উচ্চ আদালতে বহাল থাকে। উচ্চ আদালতে এদের রায় বহাল থাকলে আইন ও কারাবিধি অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। উচ্চ আদালতের একাধিক আইনজীবী জানান, অনেকগুলো মামলা দুই পক্ষের নানা আপত্তির কারণে শুনানি হচ্ছে না। আর মামলার পেপারবুক তৈরিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়াই উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্সের মামলার চাপ বাড়ছে। ২০০৫ সাল থেকে বা তার পরে ফাঁসির আদেশ হয়েছে এমন অনেকেই আট থেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কনডেম সেলে আটক রয়েছে। দেশের উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স মামলার এ জট সৃষ্টির পেছনে মামলা নিষ্পত্তিতে কমসংখ্যক বেঞ্চ থাকা এবং পেপার বুক তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতাই দায়ী। এজন্য একজন আসামির ফাঁসি হওয়ার পরে তাকে দীর্ঘদিন কনডেম সেলে থাকতে হয়। মানবাধিকার কমিশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ফাঁসির আসামির আপীল করতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। আবার আপীল মঞ্জুর হলে আপীলের নিষ্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লাগে। আসামিকে ৮ থেকে ১০ বছর হয়তো কনডেম সেলে থাকতে হচ্ছে। এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর হতে পারে না। এ ধরনের বিলকে দুর্ভাগ্যজনক, সংবিধান ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলে মানবাধিকার কর্মকর্তার দাবি।
×